মৌমাছি প্রতিপালন ! মনের ভাব প্রকাশের ভঙ্গিমা এবং কর্মদক্ষতা অবাক করে মনুষ্যসমাজকেও জানুন বিস্তারিত 

Social

মলয় দে নদীয়া:-

“মৌমাছি, মৌমাছি
কোথা যাও নাচি’ নাচি’ দাঁড়াও না একবার ভাই! ওই ফুল ফোটে
বনে যাই মধু আহরণে, দাঁড়াবার সময় তো নাই।।”
কবি নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য এর “কাজের লোক” কবিতাটা মাথায় রেখে মৌচাকের সামনে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করলে অবাক হয়ে যাবেন!
তাদের জীবনচক্রে একই সাথে রয়েছে সুষ্ঠু সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, নির্দিষ্ট আচার-ব্যবহার বাচনভঙ্গি র মাধ্যমে ভাব বিনিময়, গোত্র ভেদে পৃথক কাজের দায়িত্ব, মেনে চলার বোধ আরো কত কি! তবে সবচেয়ে আশ্চর্য রানী মৌমাছি তার উত্তরসূরীদের গোত্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
কর্মী প্রহরীবেষ্টিত দুর্গের ভেতরে রয়েছে মূলত তিন ধরনের কক্ষ! “আঁতুড়ঘর” অর্থাৎ ডিম এবং লার্ভা রক্ষণাবেক্ষণ, “ভাঁড়ার ঘর”অর্থাৎ পরাগরেণু এবং মধু সঞ্চয়, রানীকুটির অর্থাৎ হেড অফিসে গোটা পরিবারের প্রায় ৫০০০০ মৌমাছির সুবিধা অসুবিধা, ক্ষোভ-বিক্ষোভ সম্পর্কে নানান আলোচনা।

৪০ -৫০ টি পুরুষ বা ড্রন মৌমাছি শুধুমাত্র রানীর সাথে শূন্য আকাশে যৌনকর্মের মাধ্যমে গর্ভস্থ ডিমকে নিষিক্ত রাখাই তাদের কাজ। এরপর মৃত্যু! তবে সাধারণত পাঁচ মাস বাঁচে। প্রতিদিন প্রায় ২০০০ ডিম পাড়ে রানী। তিন দিনের মধ্যে ডিম ফুটে বের হয় লার্ভা, সকল কর্মী মৌমাছি, তাদের শরীর বৃত্তীয় রাসায়নিক রস বা রাজকীয় জেলি দিয়ে সিক্ত রাখে এই ডিম! এরপরেও লার্ভাপর্যায়ে ভুলবশত বা ইচ্ছাকৃত রাজকীয় জেলি খাওয়ানো হয় তাহলে তৈরি হয় রানী। লার্ভা থেকে তৃতীয় পর্যায় অনুপাতে পরিণত হওয়ার পর কর্মীরা একটি মমির আস্তরন দিয়ে কুঠুরির মধ্যে আবদ্ধ রাখে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বেড়ে ওঠার ফলে অনভিজ্ঞ অবস্থায় যাতে তারা বাইরে যেতে না পারে। যদিও একটি মৌমাছির চাকে, একাধিক রানী মৌমাছি তৈরি হয়ে যায়, তাহলে সবচেয়ে আগে পূর্ণাঙ্গ হওয়া রানী অন্য রাণীদের মেরে ফেলে। একটি রানী সাত বছরের মতন বাঁচে, ডিম দেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস হয় আসলে, কর্মীরা অন্য রানী প্রতিস্থাপন করে।
কর্মী মৌমাছির শীতে জন্মালে, তাদের দায়িত্ব শীতের হাত থেকে অতি সুখি প্রকৃতির লার্ভাদের সুরক্ষিত রাখা। এই কারণে কুঠুরির মধ্যে খুব বেশি ডানা না নাড়িয়ে, বুকে হেঁটে চলাচল করে, দৈহিক তাপমাত্রার মাধ্যমে কুঠুরির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য, এবং বাইরের কঠিন শীত ভেতরে প্রবেশ করতে না দেওয়ার জন্য নিজেরা ঘেঁষাঘেঁষি করে সংঘ বদ্ধ জীবন যাপন করে। এভাবেই পাঁচ সমাস দায়িত্ব পালনের পর তাদের মৃত্যু হয়। অন্যদিকে গ্রীষ্মকালে জন্মানো কর্মী মৌমাছির আয়ু বেশ খানিকটা কম! কঠোর রোদ্রের তাপদাহে লার্ভা দের সুরক্ষিত রাখতে, এবং কুঠুরির মধ্যে ৩০ থেকে ৩৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা বজায় রাখার জন্য, বাইরে থেকে জল এনে, ডানা নাড়িয়ে বাতাস করে শীতল রাখার মতো গুরুদায়িত্ব সামলানোর কারণে দৈহিক ক্ষয় হয় বেশি! আর সেই কারণেই আয়ু মাত্র 6 সপ্তাহ।

তবে সকল কর্মী মৌমাছির লিঙ্গ বিচারে স্ত্রী হলেও, ডিম পাড়তে অক্ষম! আবার রানির সাথে যৌন মিলনেও! তবে ঘরের কাজের সকল দায়িত্ব পালনের পরও সারাজীবনে ১ কিলোগ্রাম মধু সংগ্রহ করতে প্রতিটা মৌমাছিকে প্রায় ১ কোটি ফুলের কাছে পৌঁছাতে পেরোতে হয় সাড়ে তিন থেকে সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার পথ! ওড়ার সময় এদের গতিবেগ ঘন্টায় ২৪ থেকে ৪০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায়। এরপর পায়ে করে রেনু, এবং ভক্ষণ করা খাদ্যপ্রাণ বা ভিটামিন জারক রসে সাথে মিশে পরিণত হয় মধুতে,মানবদেহের যত ভিটামিন আছে তার ৭৫% থাকে এই মধুতে। যা কুঠুরিতে সঞ্চয় করে।

শুনলে আশ্চর্য হয়ে যাবেন, শুধুমাত্র নিজে নয়, কুঠুরির সকল কর্মীদের, বাংলার চার লেখার মত পদ্ধতিতে নেঁচে দূরত্ব, এবং প্রাপ্তির পরিমাণ সম্পর্কে অবহিত করে। এভাবেও মুখের পাশে থাকার শুঁড় তরঙ্গের মাধ্যমে পাঠানো বার্তা আদান-প্রদানের ভাষা হার মানায় বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কারকেও। শুধু এখানেই শেষ নয়! ডানা নাড়ানোর শব্দের বৈচিত্র আলাদা আলাদা বার্তা বহন করে। ভুল করে অন্য চাকের মৌমাছি ঢুকে পড়লে, গন্ধের বিচারে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করার নিয়মও যথেষ্ট কঠোর।

ইদানিং মধু চাষে অভিজ্ঞরা জানান, কার্তিক মাসে ইউক্যালিপটাস সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বাঁকুড়া, তারপরে নদিয়া মুর্শিদাবাদ এ সরষে ধনিয়া খেসারি এইভাবে পরপর সংগ্রহ পর্ব চলার পর ফাগুন মাসে সুন্দরবনে দুমাসের সংগ্রহে কিছু বাক্স পাঠানো হয় , এবং কিছু বাক্স পাঠানো হয় মাত্র ২৪ দিনে ফুলের মেয়াদ থাকা লিচুর জন্য! এরপর জ্যৈষ্ঠ মাসে তিল বা অন্য ধরনের ফুলের খোঁজে। তবে চাষের ফলে নানান কীটনাশক ব্যবহার করার কারণে, গুণগত মান বজায় থাকে না মধুর, তাই অন্য ধরনের ফুলের বিশেষত সুন্দরবনের মধু গুণগত মান ভালো। তবে ফুলের নামের বিচারে সংগ্রহীত আলাদা আলাদা রকমের মধু বিক্রিত হতে দেখা যায় ইদানিং। ছোট ছোট জীবাণুর “মাইট” লাগা রোগের ফলে, কুঠুরি নষ্ট হয়, অপর এক ধরনের জীবাণু থেকে লার্ভা পচে যাওয়ার নাম “সীপচা” রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন রকম আয়ুর্বেদিক ওষুধ। যতদিন না ফুল ফোটে ততদিন চিনি খাইয়ে খাদ্য যোগাড় রাখতে হয় মৌমাছির।

Leave a Reply