মলয় দে নদীয়া:-নদীয়ার শান্তিপুর সুত্রাগড় নতুন বাজার এলাকার বাসিন্দা ৯৫ বছরের বৃদ্ধ হরিপ্রসাদ দাস। সম্প্রতি ভারত পাকিস্তানের সংঘর্ষের আগে আরো এক যুদ্ধের সাক্ষী রয়েছেন তিনি। ১৯৭১ সালের ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের স্মৃতি আজও জ্বলজ্বল করছে তার চোখে।
তিনি জানান যুদ্ধের সময় কর্মসূত্রে আমি থাকতাম চন্দননগরে। সেখানে ছিল আমার ঠাকুর দাদার বাড়ি, তিনি পেশায় ছিলেন সংগীতের শিক্ষক। আমি তখন একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতাম বয়স তখন প্রায় ৪১। কিন্তু পরিবার থাকতো শান্তিপুরে সুত্রাগড় এলাকায় যেখানে আমি এখন রয়েছি। সেই সময়ও চলছিল একাত্তরের ভারত পাক যুদ্ধ। যেকোনো মুহূর্তে রাস্তায় বাজতো যুদ্ধের সাইরেন! মুহূর্তে ফাঁকা হয়ে যেত সমস্ত রাস্তাঘাট লোকালয়। রাস্তাঘাটের মত ট্রেনে বাসেও প্রভাব পড়েছিল যুদ্ধের। বাংলাদেশ থেকে যুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে লোহার তার দিয়ে বেঁধে নিয়ে আসা হতো গেঁদে থেকে রানাঘাট স্টেশনে। নিত্যযাত্রী বলতে খুবই কম ছিল ওই সময় ট্রেনে। মোতায়ন করা থাকতো প্রত্যেকটি কামরাতে পুলিশ।
সেই সময় লোকের পকেটে পকেটে স্মার্টফোন ছিল না যুদ্ধের খবরের আপডেট নেওয়ার জন্য, একমাত্র ভরসা ছিল পকেট রেডিও। তিনটি ভাষায় উর্দু হিন্দি এবং ইংরেজিতে পড়া হত খবর। খবরের মাধ্যমেই দেশবাসীকে দেওয়া হতো যুদ্ধের সমস্ত রকম আপডেট ও নির্দেশিকা। ওই সময় শান্তিপুরের স্বনামধন্য রেডিও ভাষ্যকার দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় খবর পড়তেন রেডিওতে। বাড়ির ছাদে উঠলে দেখা যেত আকাশে যুদ্ধ বিমানকে পাক খেতে। কখনও দেখা যেত অন্য আরেকটি সামনের বিমানটিকে ধাওয়া করতে। ছাদে ওঠা বারণ থাকলেও অল্প বয়সে কৌতূহলের কারণে অনেকেই আমরা লুকিয়ে চড়িয়ে উঠে দেখতাম সেই একাত্তরের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের লড়াই।
তবে এখনো বয়সের ভারে সেই সমস্ত স্মৃতি আজও অমলিন হয়ে যায়নি। আনন্দ পাবলিশার্সের সে সময়ে যুদ্ধের ছবি সহ বিভিন্ন তথ্য দিয়ে বইয়ের অমলিন পাতাগুলি উল্টে দেখেন ৯৫ বছরের বৃদ্ধ। এখনো দোতলা বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে চলাফেরা করেন একাই তাও দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার। বর্তমানে তার নাতি সেনাবাহিনীতে কর্মরত রয়েছেন দিল্লিতে পোস্টিং। নাতির জন্যও তিনি গর্ব প্রকাশ করেন, বলেন দেশ রক্ষার কাজ কে তিনি কুর্নিশ জানান, তাই দাদু নাতিতে মাঝে মাঝেই যুদ্ধের আপডেট সম্পর্কিত বিষয়ে কথা হয়।
একই কথা জানালেন কাশ্যপাড়ার এক বৃদ্ধাও, যুদ্ধের সময় পরিবারে মহিলাদের কাজ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তখন ছিল পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়ানক। রাস্তায় বেরনো যেত না। শান্তিপুর এমনিতেই বারো মাসে তেরো পার্বণ কিন্তু তখন কোন পুজো পার্বণে বেরোনোর প্রশ্নই ছিল না। সকালবেলা কোনভাবে দুটো রুটি করে সকলে খেয়ে নেওয়া হতো। এরপর সারাদিন বাড়ির একটা ঘরের মধ্যেই সকল সদস্যরা জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকতেন। এই বুঝি আকাশ থেকে বারুদের গোলা এসে পড়ে বাড়িতে! রাত্রেবেলা তাইচুং চালের ভাত খাওয়া হতো সেই সময়। চালের দাম ছিল তখন অনেক বেশি, তবে এই চালটি খুব তাড়াতাড়ি সহজে গলে যায় বলে এই চাল এনে খুব অল্প সময়ের মধ্যে রান্না করে বাচ্চাদের খাইয়ে দেওয়া হতো। রান্না করা হতো, ঘরের মধ্যে কেরোসিনের স্টোভে। বাইরে উনুন জ্বালিয়ে রান্না করার কোন প্রশ্নই উঠত না। লাগাতার বাইরে নিজে চলত সাইরেন চলাচল করতো পুলিশের গাড়ি, সর্বক্ষণ ভয় থাকতাম এই বুঝি বাড়ির পুরুষদের নিয়ে কখন চলে যায় যুদ্ধের ময়দানে! ২০২৫ সালের ভারত পাকিস্তানের সংঘর্ষ আবারো পরিষ্কার করে দিয়েছে একাত্তরের ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের আবহাওয়াকে। তবে দেশ রক্ষায় এই মুহূর্তে সেনাবাহিনীদের পাশে থাকা উচিত সকল নাগরিকদের বলেই মনে করেন তিনি।