পেলিং ভ্রমণ ও মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম”

Social

মানব মন্ডল : বাঙালী পেলিং এ আসে মূলত কাঞ্চনজঙ্ঘার টানে। ট্রেকিং এ অভ্যস্ত নন এমন পর্যটকের কাছে পেলিং এমনই এক আশ্চর্য স্থান যেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা খুব কাছ থেকে দেখা যায়। মনে হয় যেন হাত বাড়িয়েই ধরা যাবে। কিন্তু বাধ সাধে প্রকৃতি। বাঙালীর ছুটি বলতে গরমের ছুটি আর পুজোর ছুটি। গরমের ছুটিতে পেলিং এলে মেঘের উৎপাত বড় বেশী বলে বাঙালীরা পুজোর ছুটিতেই পেলিং যাওয়া পছন্দ করেন। কিন্তু এ বছর বর্ষাসুর বিদায় নেবার নাম করছে না। তাই এই অক্টোবর মাসেও পেলিং থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার নিশ্চয়তা থাকছে না। তার ওপর রয়েছে sight seeing এর ঝক্কি। আগে যাঁরা পেলিং গেছেন তাঁরা জানেন যে পেলিং এ ঘোরার জায়গার অভাব নেই । কাঞ্চনজঙ্ঘা ফলস,রিম্বি ফলস,দাড়াপ ভিলেজ,khecheopalri Lake, হেলিপ্যাড,মনিস্ট্রি, রাবডেন্টসে রুইনস সহ আরও কয়েকটি জায়গা।

এইসব জায়গাগুলোর মধ্যে অনেকেই Pemayangtse Monastery যান না। বলা ভাল যাবার সময় থাকে না। সকালে হোটেল থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে গাড়ি করে ছোটেন ইয়াকসামের দিকে। অসম্ভব সুন্দর ঝর্না, পাহাড়ি গ্রাম ইত্যাদি দেখে ফিরে আসেন হোটেলে। বর্তমানে পেলিং এ গেলে আপনাকে একটু অন্যরকম ভাবে পরিকল্পনা করতেই হবে। এখন যে সব ট্রাভেল এজেন্সি পেলিং এর sight seeing করায় তারা প্রথমেই আপনাকে নিয়ে যায় দাড়াপ ভ্যালি হয়ে রিম্বি ফলস, এরপর রিম্বি orange garden,তারপর Khecheopalri Kake, তারপর নিয়ে যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা ফলস। গাড়ি ফিরতি পথে আবার পেলিং এসে আপনাকে লাঞ্চ করাবে। তারপর নিয়ে যায় পেলিং এর সাম্প্রতিক আকর্ষণ Sky Walk….এ। এসব করতে গিয়ে যা সময় লাগে তাতে বিকেল তিনটের আগে skywalk এ পৌঁছনো মুশকিল। তাতে একটু সমস্যা আছে। বর্তমান পেলিং এ যে জায়গায় sky walk সেটি যথেষ্ট উঁচু জায়গা এবং বেলা বাড়ার সাথে সাথেই মেঘের আনাগোনা বাড়তে থাকে। যদি ডিসেম্বরের ছুটিতে যান তাহলে এসব সমস্যায় নাও পড়তে পারেন কিন্তু অন্য সময়ে গেলে সমস্যায় পড়তে পারেন। দুপুরের পর দৃশ্যমান্যতা কমে যাওয়ার জন্য কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখাই যায় না। এমনকি ১৩৭ ফুট উঁচু চেনরেজিগ স্ট্যাচুও ভালোভাবে দেখা যায় না। তাই পেলিং এ একটু সময় দিন। সক্কাল সক্কাল চলে আসুন sky-walk এ। এমনিতে জায়গাটা সকাল ৯ টায় খোলে কিন্তু পর্যটক থাকলে সকাল সাতটাতেই খুলে দেয়। কথা দিচ্ছি। মুগ্ধ হবেন। আপনি কাঁচের ওপর দিয়ে হাঁটবেন আর আপনার সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা ঝকঝক করবে।

পাশেই সু-উচ্চ পদ্মাসনে বসে আছেন অবলোকিতেশ্বর। অনেকেই এঁকে বুদ্ধমূর্তি বলে ভুল করেন। বিশদে জানার জন্য বৌদ্ধ দেবদেবী সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা থাকা দরকার। মহাযান বৌদ্ধ ধর্মে অজস্র দেবদেবী আছে। এইরকম দেবদেবীর কল্পনা কোথা থেকে এল? বৌদ্ধ মতে জগতের কারণ আসলে মহাশূন্য ! সেই মহাশূন্য নিজেকে পাঁচভাগে ভাগ করেন–রূপ,বেদনা,সংজ্ঞা,সংস্কার ও বিজ্ঞান (science নয়)। বৌদ্ধ দেবমন্ডলে তাই আদি দেবতা আদিবুদ্ধ। ইনিই সৃষ্টির কারণ শূন্য বা বজ্র। এই আদিবুদ্ধ নিজেকে পাঁচটি ধ্যানীবুদ্ধ আকারে প্রকাশ করেন। এঁরা হলেন– বৈরোচন(রূপ স্কন্ধ),রত্নসম্ভব(বেদনাস্কন্ধ),অমিতাভ(সংজ্ঞাস্কন্ধ),অমোঘসিদ্ধি(সংস্কারস্কন্ধ)ও অক্ষোভ্য(বিজ্ঞান স্কন্ধ)। এই পাঁচজন ধ্যানীবুদ্ধ পাঁচটি স্কন্ধের অধিষ্ঠাতৃ দেবতা। এই ধ্যানীবুদ্ধ থেকে বুদ্ধশক্তি উৎপন্ন হয় এবং সেখান থেকে বোধিসত্ত্ব উৎপন্ন হয়। এই বোধিসত্ত্বরাই মানুষকে বুদ্ধ হতে সাহায্য করেন। আমরা বুদ্ধ বলতে শুধু গৌতম বুদ্ধ বা শাক্যসিংহের কথা জানি। কিন্তু মহাযান বৌদ্ধমত বলে ‘বুদ্ধ’ আসলে একটা অবস্থার নাম। চেষ্টা কর, তুমিও বুদ্ধ হতে পারবে। শাক্যসিংহ বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। তুমিও বুদ্ধত্ব লাভ করতে পারবে। সেই বুদ্ধত্ব লাভের জন্য বোধিসত্ত্বের প্রয়োজন। আর তাই মহাযান তন্ত্রে বোধিসত্ত্বের স্থান শাক্যমুনির চেয়েও উঁচুতে। এখন যে কল্প চলছে তাকে বৌদ্ধমতে বলে ভদ্রকল্প। এই কল্পে যে বোধিসত্ত্ব আমাদের বুদ্ধত্বপ্রাপ্তির পথে সাহায্য করবেন তিনি অবলোকিতেশ্বর। বাংলা একসময় তান্ত্রিক বৌদ্ধমতের পীঠস্থান ছিল। বাংলা থেকেও তাই বহু অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি পাওয়া গেছে। মোট একশো আটটি রূপে অবলোকিতেশ্বর কল্পিত হন। এঁদের মধ্যে পেলিং এ ১৩৭ ফুট উঁচু যে মূর্তিটি আছে তিনি ষড়ক্ষরী লোকেশ্বর(তিব্বতি ভাষায় chenrezig)। কারণ এই দেবতার ধ্যানমন্ত্রে ৬টি অক্ষর আছে। মন্ত্রটি হল–“ওঁ মণিপদ্মে হুঁ”। এই মন্ত্র জপ করতে করতে যে অবলোকিতেশ্বরের দর্শন হয় তিনি চতুর্ভুজ,সর্বালংকার ভূষিত। তাঁর প্রধান দুই বাহু অঞ্জলি মুদ্রায় বুকের কাছে রক্ষিত। অপর হাতদুটির মধ্যে ডান হাতে অক্ষসূত্র বা রুদ্রাক্ষ মালা এবং বাম হাতে পদ্মফুল থাকে। তিনি মাথায় পাঁচজন ধ্যানীবুদ্ধকে ধারণ করে আছেন। হাতের মুদ্রা দেখে পাঁচজন ধ্যানীবুদ্ধকে আলাদা করে চিনতে হয়। লেখার ব্যাপ্তির কারণে সেসব লেখা থেকে বিরত থাকলাম। এই বোধিসত্ত্বেরা কোন ধ্যানীবুদ্ধ থেকে জাত তা তাঁরা তাঁদের মুদ্রা,বর্ণ বা মস্তকের ধ্যানীবুদ্ধমূর্তির মাধ্যমে প্রকাশ করেন। পেলিংএর এই মূর্তিটির মাথার মুকুটে দুটি নীল রং এবং একটি সাদা রং এর ছোট গোলাকার পাথর বসানো আছে। যা যথাক্রমে অক্ষোভ্য এবং অমিতাভকুলকে নির্দেশ করে। অজস্র দেবদেবী, যুগনব্ধ মূর্তি, গুহ্যতন্ত্র প্রভৃতি নিয়ে সিকিমের বৌদ্ধ গুম্ফাগুলো আপনার জন্য সাজিয়ে রেখেছে অপার বিস্ময়। ঘুরে আসুন—অবলোকিতেশ্বরের কৃপায় শূন্য মনও প্রাপ্তির আনন্দে ভরে উঠবে।