হাম্ফিঃ এক হারিয়ে যাওয়া সমৃদ্ধ রাজধানী

Social

নিউজ সোশ্যাল বার্তা,১৫ই অক্টোবর ,মিলন রায় : অক্টোবর মাসের এক নতুন সকাল বিজয়নগর সাম্ৰাজ্যের অধুনালুপ্ত রাজধানী হাম্পিতে পৌঁছে দেয়। উত্তর কর্ণাটকের বেল্লারি জেলায় হাম্পি অবস্থিত। স্থানীয় ভাষায় হাম্পিকে পাম্পা-ক্ষেত্ৰ অথবা ভাষ্করা ক্ষেত্ৰ বলে জানা যায়, ভাষ্কর নামটি পাম্পার থেকে উৎপত্তি হয়েছে, যা তুঙ্গভদ্ৰা নদীর প্ৰাচীন নাম। চতুৰ্দশ এবং ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যবৰ্তী সময়ে দক্ষিণ ভারতের অন্যতম একটি সমৃদ্ধ নগরী হিসাবে গড়ে উঠেছিল বিজয়নগর রাজ্য। ১৩৩৬ খ্রীঃ হরিহর ও তাঁর ভ্রাতা বুক্কা এই নগরীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে একাধিক ইউরোপীয় পর্যটক ডমিনগো পায়েজ, ফার্নাও নুনিজ, নিকোলো ডি কন্টি প্রমুখ পর্যাটক ও বণিকের আগমন ঘটেছিল এই সমৃদ্ধ নগরীতে এবং তারা নগরী ও মন্দিরসমূহের ভূয়সী প্ৰশংসা করে গেছেন। ১৫২০ খ্রীঃ আগত ডমিনগো পায়েজ বিজয়নগরকে রোমের মত বৃহৎ শহর বলেছেন। হেমকূট, মাতঙ্গ ও মাল্যবন্ত পাহাড় প্রহরী রুপে হাম্পি শহরকে রক্ষা করছে। শহরের চারিদিকেই ছড়িয়ে রয়েছে মন্দির, সৌধ, স্থাপত্য। এখানকার বিরুপক্ষ মন্দির, বিজয় বিট্টলা মন্দিরের মনোমুগ্ধকর স্থাপত্য আমাদেরকে প্রাচীন সমৃদ্ধ বিজয়নগরের ঐতিহাসিক দিনগুলিতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এই স্মারকসমূহ ইউনেস্কোর বিশ্বঐতিহ্যের তালিকা অনুযায়ী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মৰ্যাদাপ্ৰাপ্ত। মধ্যযুগে ভারতীয় জীবনসংস্কৃতি কতটা উন্নত ছিল তা আমরা এই নগরীর ধ্বংসাবশেষ দেখেও অনুমান করতে পারি। বলা হয়ে থাকে এখানকার রাস্তায় বিশেষত পান সুপারি ষ্ট্রীট এ হীরে বিক্রি হত। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এখানে হাম্ফি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

কি কি দেখবেন ?
রুক্ষতার অনুপম সৌন্দর্য হাম্ফিতে এসে খুঁজে পাওয়া যায়। দুটি দিনে ভাগ করে নিয়ে প্রথম দিনে দক্ষিণ হাম্ফি ও পরের দিন তুঙ্গভদ্রা নদীর অপর প্রান্তের স্থান গুলি দেখে নিতে পারেন। অটোর পাশাপাশি মটরবাইক বা রেসিং বাইসাইকেল ও ভাড়া পাওয়া যায়। দক্ষিণ হাম্ফিতে বিরুপাক্ষ মন্দির, রাণীর আভিজাত বিলাসমহল, স্নানাগার, লোটাস মহল, হাতিশালা আমাদের এক স্বপ্নের জগতে নিয়ে যায়। উত্তর হাম্ফিতে অবস্থিত আনেগুন্ডির (কিস্কিন্ধ্যা) অঞ্জনাগিরি পাহাড়ে হনুমানের জন্মস্থানে নির্মিত মন্দিরটি দেখার মত। ৫৭৪ টি ধাপ অতিক্রম করে উঠতে হয়। এছাড়া এখানকার আনেগুন্ডির দুর্গ, পম্পা সরোবর, বুক্কাস অ্যাকুইডাক্ট (স্টোন ব্রিজ) দেখতে পারেন।

• ভিট্টলা মন্দির এবং বাজারঃ বিজয়নগরীয় স্থাপত্যের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নিদর্শন ছিল এই ভিট্টলা মন্দির। বিরুপাক্ষ মন্দিরের উত্তরপূর্ব দিকে ভিট্টলা মন্দিরটি অবস্থিত। মন্দিরটি বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের অপর এক রূপ ভিট্টালা কে উৎসর্গ করা হয়েছে। দ্বিতীয় দেবরায় (১৪২২-৪৬)র পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মাণ হয়েছিল এবং কৃষ্ণদেব (১৫০৯-১৫২৯)র সময় এর বর্তমান রূপ যুক্ত হয়েছিল। এই মন্দিরের ভিতরে বিখ্যাত পাথরের রথ অবস্থিত। এটা আসলে বিষ্ণুর মন্দির, বিষ্ণুর রথের প্রতিরুপ। বিবাহ হল (Orante Kalyana Mantapa), উৎসব হল (Utsab Mantapa) এই মন্দির ক্ষেত্রের মধ্যেই অবস্থিত। মন্দির ক্ষেত্রের বাইরে একটি বৃহৎ বাজার এবং ৯৪৫*৪০ মিটার একটি পবিত্র জলাশয় আছে যা লোকাপাবনী (Lokapavani) নামে পরিচিত।
বিরুপাক্ষ মন্দিরঃ বিরুপাক্ষ বা পাম্পাপীঠ মন্দির হাম্পির প্রাচীনতম, প্রধান, ও পবিত্রতম মন্দির। বিরূপাক্ষ শিবের আরেক নাম। এই মন্দিরে প্রধান দেবতা শিব এবং তাঁর পত্নী দুর্গা যিনি এখানে পাম্পা নামে পুজিত হন। এখানে সন্ধ্যা ৭ থেকে ৭.৩০ পর্যন্ত আরতি হয়। চতুর্দশ শতকে এখানে স্থানীয় শিল্প ওঁ সংস্কৃতির উৎকর্ষতা চরম পর্যায়ে ছিল। ষোড়শ শতকে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পতনের পর এই অসাধারণ শিল্প নিদর্শনগুলি ধ্বংস হতে থাকে। তবে সম্প্রতি সংস্কারের মাধ্যমে মন্দিরটির প্রাচীন রূপটি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
হজাররাম মন্দিরঃ হজাররাম মন্দিরকে রামচন্দ্রের মন্দির বলে অভিহিত করা হয়েছে। রামায়ণের রামকে এই মন্দিরটি উৎসর্গ করা হয়েছে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে প্রথম দেবরায় নির্মিত এই মন্দিরটিতে দ্রাবিড় শিল্প রীতির ছাপ সুস্পষ্ট ভাবে লক্ষ্য করা যায়। মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে মহানবমী (দশেরা) এবং হলি উৎসবের চিত্র শিল্পকলার মধ্যদিয়ে তুলে ধরা হয়েছে।
রাণীর স্নানকুন্ডঃ রাজপ্রাসাদের দক্ষিণ পূর্ব দিকে রাণীর স্নান কুণ্ডটি অবস্থিত। বিজয়নগরের স্থাপত্যত্যে ভারতীয় ইসলামীয় শিল্পধারার এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন। ৩০*১৫*১.৮ বর্গমিটারের এই স্নান কুণ্ডে পূর্ব দিক দিয়ে জল নির্গমনের ব্যবস্থা ছিল।
• মহানবমী প্লাটফরম, পাবলিক স্কয়ারঃ রাজবাড়ির উত্তর পূর্ব দিকে ৮ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট তিনটি ধাপে গ্রানাইট পাথরে নির্মিত এই মঞ্চটি বৃহৎ মঞ্চ, দশেরা বা মহানবমী ডিব্বা নামে পরিচিত। এই মঞ্চের ধাপগুলিতে বিজয়নগরীয় স্থাপত্যে রীতির বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। এই মঞ্চটি রাজপরিবারের বিভিন্ন উৎসব যেমন রামনবমীর জন্য ব্যবহার করা হত।
• ১৯৮০ খ্রীঃ উৎখননের মাধ্যমে উন্মুক্ত হয়েছে মহানবমী মঞ্চটির দক্ষিণদিকে গ্রানাইট পাথরে নির্মিত বৃহৎ চতুষ্কোণ ধাপযুক্ত জলাধার। এটি মূলত রাজকীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহার করা হত।
গানিঘাট্টি জৈন মন্দিরঃ এই মন্দিরটি জৈন তীর্থঙ্কর কুন্তনাথকে উৎসর্গ করা। দ্বিতীয় হরিহর ১৩৮৬ খৃীঃ এই মন্দিরটির স্থাপন করেছিলেন। একটি উচ্চ আলোকস্তম্ভ মন্দিরের প্রবেশ পথের দিকে রয়েছে। এটি বিজয়নগরের শিল্পধারার পরিচয় বহন করে থাকে।
কৃষ্ণ মন্দির, নরশিমহা বিগ্ৰহঃ বিরুপাক্ষ মন্দিরের দক্ষিণ দিকে হেমকূট পাহাড়ে কৃষ্ণ মন্দির অবস্থিত যা বালকৃষ্ণ মন্দির নামেও পরিচিত। ধ্বংস প্রাপ্ত মন্দিরের সামনে বৃহৎ বাজার অবস্থিত। এর উত্তর দিকে একটি বৃহৎ পুষ্করিণী অবস্থিত যা জনগণের বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহার করা হত।
হাম্পিতে সূর্যাস্তঃ হেমকূট পাহাড় থেকে সূর্যাস্তের অনুপম সৌন্দর্য মনকে শান্তি দেয়। মাতুঙ্গা পাহাড় থেকেও সূর্যাস্ত দেখতে পাওয়া যায়। তবে এখানকার ওঠার রাস্তাটা বেশ ঝুকি প্রবণ। বয়স্কদের এড়িয়ে চলাই ভালো।
• তুঙ্গভদ্রা নদীতে ছোট ছোট বাঁশের তৈরি গোল দাড় যুক্ত নৌকাগুলিতে অবশ্যই চড়বেন। ৫০০ বছরের বেশী সময় ধরে এই নৌকা ব্যবহার হয়ে আসছে। স্থানীয় ভাষায় একে ‘গোন্ডলা’ বলা হয়ে থাকে। তুঙ্গভদ্রা নদীর পাশাপাশি সোনাপুর হ্রদে এই নৌকায় ভ্রমণের সুযোগ রয়েছে।

     কিভাবে যাবেন ?
হাম্পির নিকটবর্তী রেল স্টেশন হসপেট যা ১৬ কিমি দূরে অবস্থিত। হসপেট থেকে অটো, বাস, বিভিন্ন প্রাইভেট গাড়িতে হাম্ফি পৌঁছানো যায়। হাওড়া থেকে অমরাবতী এক্সপ্রেস (সোম, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি) সরাসরি হসপেট যায়। এছাড়া বেঙ্গালুরু ও হায়দ্রাবাদ থেকে অনেক ট্রেন হসপেট আসে। কলকাতা থেকে বিমান পথেও বেঙ্গালুরু পৌঁছে সড়কপথে হাম্ফি আসা যায়।

কোথায় থাকবেন ?
হাম্ফির বিরুপাক্ষ মন্দিরের পাশে বেশিরভাগ বাড়িগুলি গেস্ট হাউসে পরিণত হয়েছে। তুঙ্গভদ্রা নদীর উল্টো দিকেও বিরুপুরাতেও একাধিক রেস্ট্রুরেন্ট, গেস্ট হাঊস দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া হসপেটেও ভালো ভালো হোটেল আছে।