হস্তচালিত তাঁতের সংকটে এগিয়ে এল “ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ফ্যাশন টেকনোলজি”

Social

হস্ত চালিত তাঁতের সংকটে এগিয়ে এল কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান, আশায় জেলার কয়েক লক্ষ তাঁতি

মলয় দে নদীয়া :- মাত্র ৩০০ টাকায় তাঁত জামদানি, তাঁত বেনারসীর মত “কুলিন গোত্রের” তাঁত শাড়ি তাও পাওয়া যাবে মাত্র ৫০০ টাকায়! এই সবটাই সম্ভব হচ্ছে যন্ত্রচালিত তাদের কল্যাণে। হস্ত চালিত তাতে একটি জামদানি শাড়ি তৈরি করতে গেলে শ্রমিক মজুরি বাবদ যেখানে খরচ হয় ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা সেখানে মাত্র ৩০০ টাকায় গোটা শাড়ী হাতে পাচ্ছেন ক্রেতারা, তাই তুল্য মূল্য প্রতিযোগিতার বাজারে কোণঠাসা হতে হতে অস্তিত্ব সংকটে হস্তচালিত তাঁত শিল্পীরা।

নদিয়ার শান্তিপুরের হস্তচালিত তাঁত শিল্পীদের এই সংকটে পাশে এসে দাঁড়ালেন “ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ফ্যাশন টেকনোলজি” কলকাতা শাখার পড়ুয়া ও গবেষকরা। উৎপাদন ব্যয় হ্রাস, সময় উপযোগী ‘ফ্যাশনেবল’ পোশাক উদ্ভাবন ও তার বিপণন নিয়ে হস্তচালিত তাঁত শিল্পীদের সাথে মত বিনিময় করলেন প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক, গবেষক ও স্নাতকোত্তর পড়ুয়াড়া। কার্যত নীরক্ষর বছর ৫৫ বছর বয়সী হস্ত চালিত তাঁত শিল্পী সুকৃতি বালার হাতে ধরে “ফ্যাশন টেকনোলজিস্ট” অমিয় মহাপাত্র শেখালেন ‘ঐতিহ্যের সাথে আধুনিকতার মেলবন্ধনের পাঠ’। কোনদিন বিদ্যালয় মুখি না হলেও জীবন সায়ন্নে দাঁড়িয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পৌড় তাঁত শিল্পী বাধ্য ছাত্রের মত শিখলেন সবটা। এভাবেই তিনদিন শান্তিপুর ফুলিয়ার একাধিক অঞ্চলের হস্তচালিত তাঁত শিল্পীদের উৎপাদিত কাপড়ের আধুনিকতা ও বিপণন প্রশিক্ষণ দিলেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ফ্যাশন টেকনোলজির বিশেষজ্ঞরা।

ঐতিহ্যমণ্ডিত শান্তিপুরের তাঁত শিল্পে এখন চরম দুর্দিন। করনার সময় থেকে একের পর এক বন্ধ হয়েছে তাঁত শিল্পীদের ঘর। যন্ত্র চালিত তাঁতের বাজারমুখী প্রতিযোগিতা ও আধুনিকতার অভাব- এই জোড়া ফলাতে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শান্তিপুর ফুলিয়ার একাধিক গৃহস্থালি ও কারখানার তাঁত। পুরুষানুক্রমে তাঁতনির্ভর জীবিকা নির্বাহ করায় যারা অভ্যস্ত, তাদের আনেকেই উপায় না দেখে ভিন্ন পেশায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। গত তিন শান্তিপুর ফুলিয়া ও নবদ্বীপের অর্ধেক তাঁতই বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁতির মোট সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র কয়েকশোতে। ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যন্ত্র চালিত তাঁত বিপ্লবের ফলে হারিয়ে গেছে প্রায় সহস্ত্রাধিক তাঁত। শান্তিপুরের তাঁত দেশে তো বটেই দীর্ঘকাল বিদেশেও অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ছিল। এখন আর সেই গৌরব নেই। নদিয়ার ঐতিহ্যবাহী তাঁতের জন্য সুদূর অতীতে ‘প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার’ হিসেবে সুপরিচিত ছিল । বর্তমানে হস্তচালিত তাঁতশিল্প বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় অস্তিত্বের সংকটে ধুকছে।

নদিয়ার জেলা জুড়ে তাঁত শিল্পীদের উন্নয়নে শুমারির কাজ হয়েছে বারংবার। সর্বশেষ শুমারি অনুসারে সরকারি হিসাব বলছে- জেলাজুড়ে প্রায় আড়াই লক্ষ হস্তচালিত তাঁতশিল্পী রয়েছেন। বাস্তব বলছে অন্য কথা, খাতায় -কলমে তারা তাঁত শিল্পী হলেও পেশা বদলে তারা হকারীর মত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছে। তবে তাঁত শিল্পীদের খাতায় কেন তাদের নাম? উত্তরে শান্তিপুরের প্রবীণ তাঁত শিল্পী রবীন বসাক জানালেন” চার পুরুষ ধরে তাঁত বুনি, তাই কাজ না করলেও নামটা রেখেছি। যদি কোনদিন সরকার সুবিধা দেয় ভাঙাচোরা তাঁত সেরে নিয়ে আবার কাজে নামব”। হস্তচালিত তাতে রুজি রোজগার না হওয়ায় পেশা বদলে এখন বিড়ি বাঁধেন নবদ্বীপ বাবলারী এলাকার রমলা শীল, আক্ষেপের সুরে তিনি জানালেন ” হাতে বোনা তাঁতের কদর আর কজন করে, পাওয়ারলুমের কমদামের কাপড় নিয়ে সবাই মাতামাতি করছে। সোনা আর রাং কখনো কি এক হয়!”

এই সংকটেও আশার আলো দেখাচ্ছে কলকাতার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ফ্যাশন টেকনোলজির অধ্যাপক গবেষকরা। তিন দিনের পরিদর্শন ও প্রশিক্ষণ কর্মশালা শেষে অধ্যাপক ডক্টর সন্দীপ মুখার্জী জানান “হস্ত চালিত তাঁতের একটি বিরাট বাজার আছে। শুধু তার সঠিক বিপণন ও পোশাকের ধরনের আধুনিকীকরণ দরকার – আমরা সেই কাজটাই করে যাচ্ছি”। শান্তিপুরের মহিলা তাঁত শিল্পীদের নিয়ে তৈরি হওয়া একটি স্বয়ংভর গোষ্ঠীর সাথে যৌথভাবে কাজ করছে এই কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান l শান্তিপুর স্থানীয় তাঁতিরা তারা জানেন তাঁতের বুনন , পোশাকের উৎকর্ষতা ও অভিনবত্বের দিকটি দেখছেন ফ্যাশন টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের গবেষকরা- এই দুইয়ের মেলবন্ধনে হস্তচালিত তাঁত শিল্পের তার অতীত গরিমা পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখছেন এই পেশার সাথে যুক্ত জেলার কয়েক লক্ষ মানুষ।

Leave a Reply