মলয় দে নদীয়া :- পা আছে দুটোই তবে, ডান পা গোড়ালি থেকে কাটা। নদীয়ার শান্তিপুর বাগদেবী পুরের বাসিন্দা সুশান্ত সরকারের দু পায়ে ভর করে একসঙ্গে কুড়িটা ইঁট নিয়ে তর তর করে দোতলায় উঠতেন। কাল হলো সেই ইঁটই। দুবছর আগে জোগাড়ের কাজের সময়, একতলার ছাদে কাজ করা রাজমিস্ত্রির হাত ফসকে পড়ে, নিচে সুশান্তবাবুর গান পায়ে। গোড়ালি থেকে কেটে বাদ দিতে হয়। তবে স্যার ব্যায়ভার রাজমিস্ত্রি বা বাড়ির মালিক কেউই নেননি, প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে সুশান্ত।
অভাবের সংসারে বাবা ও মা বাদেও, এক ছেলে এক মেয়ে। বাধ্য হয়ে ছেলের পড়াশোনা বাদ দিয়ে, মোটর গ্যারেজে দৈনিক 70 টাকার রোজে কাজ শুরু করতে হয় সাবালক হওয়ার আগেই। স্ত্রী সংসারে হাল ধরার জন্য বেছে নেন তাঁতের কাজ। তবে সমস্ত সংসারের দায়-দায়িত্ব সেরে যেটুকু সময় পান তা দিয়ে মাসে ৫০০ টাকার বেশি উপার্জন হয় না। উপযুক্ত পাত্র পেয়ে ধার দেনা করে একমাত্র মেয়েকে পাত্রস্থ করতে পেরেছেন শান্তি বলতে ওইটুকুই। তবে সেই ধার দেনা, শোধ দেওয়ার জন্য কাটা পা নিয়েই, ছেলের পাওয়া সরকারি সবুজ সাথীর সাইকেলের পেছনে ক্যারিয়ারে ক্যারেট বেধে, গ্রামে শহরে ঘুরে বিক্রি করছেন , আড়তে অবিক্রিত বাঁধাকপি ফুলকপি। তবে এক পায়ে প্যাডেল করার কারণে ২৫ কেজির বেশি বহন করতে পারেন না তিনি। বাড়ির কাছাকাছি গোবিন্দপুর পাইকারি আড়ৎ। সবজির ব্যবসা করতে গেলে, লাগবে প্রচুর টাকা। তাই এই বাজারে মাত্র ১০০ টাকা পুঁজি নিয়ে, এক পায়ে ভর করে জীবন সংগ্রামের লড়াই করে যাচ্ছেন তিনি।এতকিছু থাকতে, ফুলকপি বাঁধাকপি কেনো? প্রশ্নের উত্তরে সুশান্ত বাবু বলেন, ১০০ টাকা পুজিতে , কমক্রিত সবজি ছাড়া উপায় নেই। তাই এ সময়, ২ টাকা কেজি বাঁধাকপি এবং তিন টাকা পিস ফুলকপি কিনে গড়ে ৫ টাকা পিস বিক্রি করে , ৭০-৮০ টাকা আয় করা যায় দুপুর দুটোর মধ্যে। তবে ভোর সাড়ে চারটেতে পাইকারি বাজার আরম্ভ হলেও , তিনি বাড়ি থেকে চা মুড়ি খেয়ে পৌঁছান ৭ টার সময়, অতিরিক্ত ভোরে একদিকে যেমন ভিড় থাকে তেমনি দাম থাকে সবজিরও। তাই একটু বেলা করে আসলে, দোকানীরাই সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে ক্যারেটে সাজিয়ে, ঠিকমতো বেঁধে দেন। অন্যদিকে দামও কম নেন। তবে এক দেড় মাসের ব্যবসার অভিজ্ঞতায়, সুশান্ত সরকার আগামীতেও মরশুমী বিভিন্ন ধরনের আনাজ সস্তায় কিনে এইভাবেই ব্যবসা চালিয়ে যেতে চান। তিনি বলেন সরকারি দু টাকা কেজি চাল, প্রতিবন্ধী ভাতা প্রতিমাসে এক হাজার টাকা, এবং নতুন ব্যবসার উপার্জন দিয়েই চলবে তার সংসার। অন্যের কাছে হাত পাতার থেকে ঢেড় ভালো।
তবে, সুশান্তবাবুর ক্রেতাদের সাথে ব্যবহার এবং হাঁক দেওয়া কৌশল মুগ্ধ করেছে ক্রেতাদের। স্বল্প দামের মধ্যেও, প্রতিদিন নিত্য নতুন অফার ঘোষণা করেন তিনি। কখনো পাঁচটি বাঁধাকপির সাথে একটি ফুলকপি ফ্রি, কখনো বা উল্টো। সুশান্তবাবুর মা, অমলা সরকার জানান, সেসময় কীর্তন গান করতে যেত ছেলে, এখন আর দূরের পথ যেতে পারেনা, এতগুলো পেট একটা পায়ের উপর ভর করে। নিজে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে কাজ করার সুবাদে দুর্ঘটনার আগে, চারিদিকে কিছুটা করে দেওয়াল তুলেছিলো নিজেই, ছাদ আর দেওয়া হয়নি। আর সেই কারণেই সরকারি গৃহ আবাস প্রকল্প থেকে বাদ, প্রতিবন্ধী ভাতা চালু হওয়ার কারণে নাকি একই বাড়িতে আর বার্ধক্য ভাতা দেওয়া সম্ভব নয়, তাই বাধ্য হয়েই ওকে নতুন চিন্তাভাবনা শুরু করতে হয়েছে।