মানব মন্ডল: তারকেশ্বরের মন্দিরের প্রতিষ্ঠা ঠিক কবে তা নিয়ে মতভেদ আছে। তবে সর্বাধিক স্বীকৃত মত হল রাজপুত রাজা ভারমল্লই এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন। অনেকে ‘মল্ল’ নাম দেখে ভারমল্লকে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজার সাথে জুড়ে দিতে চান, কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে যুক্তি হল, তাঁরা কি আকবরের সভাসদ তোডরমল্লকে তবে বিষ্ণুপুর নিবাসী বলবেন? যাই হোক, মন্দিরটি ক্রমে দশনামী সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীদের হাতে গিয়ে পড়ে। ভারমল্ল রাজার গোয়ালা মুকুন্দ ঘোষ এই মন্দিরের প্রথম সেবাইত এবং কথিত আছে যে জঙ্গলের মধ্যে তিনিই তারকনাথের শিলা আবিষ্কার করেন। মন্দিরের মোহন্ত আজীবন ব্রহ্মচারী রূপে দেবসেবা করবেন, এমনটাই ছিল ভারমল্লের নির্দেশ। কিন্তু এক শতাব্দীর মধ্যেই মোহন্তদের নামে গুরুতর অভিযোগ উঠতে থাকে। ১৮৭৩ সাল নাগাদ মোহন্ত মাধব গিরী এক ভীষন গোলমেলে ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েন। তারকেশ্বরের অদূরেই কুমরুল বলে একটা গ্রাম আছে। সেই গ্রামের জনৈক ব্যক্তি নবীনের স্ত্রীর নাম ছিল এলোকেশী। নবীন কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকত। মোহন্ত মাধব গিরীর ‘দিব্য’নজর গিয়ে পড়ে এলোকেশীর ওপর। বাড়ির লোকেদের ধর্মান্ধতার সুযোগ নিয়ে মোহন্ত সন্তান হওয়ার ওষুধ দেবার নামে এলোকেশীকে তারকেশ্বর মঠে নিয়ে আসেন। তারপর যা হবার তাই হয়। মোহন্তর নিজস্ব গুন্ডাবাহিনী ছিল। তার নামখানা বেশ জম্পেশ। “বীরভদ্র বাহিনী”। সেই বাহিনীর দাপটে তখন তারকেশ্বরের খুব খারাপ অবস্থা। এখানে বলে রাখি, দেবসেবার নামে আসলে মোহন্তরা তারকেশ্বরের জমিদারী ভোগ করতেন। মন্দিরের যে কি বিপুল পরিমাণ আয় হত তার কোন হিসেব নেই। সবকিছুর মালিক ওই মোহন্ত। যাই হোক, এলোকেশীর সর্বনাশের কথা স্বামী নবীনের জানতে আর বাকি থাকে না। নবীন ফিরে আসতে এলোকেশী তার কাছে ক্ষমাভিক্ষা করে। নবীন সব ভুলে এলোকেশীকে নিয়ে তারকেশ্বর ছেড়ে পালিয়ে যেতে চায়। কিন্তু পথ আটকায় মোহন্ত গুন্ডাবাহিনী। রাগে, হিংসায় উন্মত্ত নবীন আঁশবটি দিয়ে এলোকেশীর মুন্ডু কেটে থানায় আত্মসমর্পণ করে। নবীন এবং মোহন্ত দু-জনেই গ্রেপ্তার হন। কংগ্রেস নেতা ও সংগঠক অতুল্য ঘোষ তাঁর স্মৃতিচারণায় এই কাহিনীর উল্লেখ করেছেন। এছাড়া সেকালে মোহন্তর এই কান্ড নিয়ে বহু ছড়া-গান-নাটক-ছোট বই ইত্যাদি রচিত হয়েছে। বিচারে মোহন্তর যাবজ্জীবন কারাবাস হয় এবং মোহন্ত তিনবছরের সশ্রম কারাদন্ড হয়। নবীনের মুক্তির পক্ষে জনমত গড়ে ওঠে, হাজার হাজার লোকের সই সংগ্রহ হয়। অবশেষে ১৮৭৫ সালে নবীন ছাড়া পায়।সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হল, হুগলী জেলের যে ঘরে মোহন্ত থাকতেন সেই সেলের বাইরে তাঁর চরণবন্দনা করার লোকের অভাব হত না। অনেক মানুষের চোখেই তিনি তখনও তারকনাথের প্রধান পূজারী, অতএব সব দোষ মাপ!! ধর্মের মোহ যে সেকালের বাংলায় কি মারাত্মক ছিল এইসব ঘটনা সেটাই প্রমাণ করে। শুধু তাই নয়, সেই মোহন্ত জেল খেটে ফিরে এসে আবার মোহন্তর গদিতে বসেন। যুক্তি দেন, উনি যেহেতু দশনামী সম্প্রদায়ের সাধু, তাই ওনার পরস্ত্রী গমনে বাধা নেই!!! এমনও হয়!! হ্যাঁ, এমনটাই হয়েছিল। শুধু মাধব গিরী নন, মোহন্তের পদে এর পরেও যাঁরা বসেন তারা প্রায় সবাই নানা কুকীর্তিতে জড়িয়ে পড়তে লাগলেন। বলা বাহুল্য, এসব সত্ত্বেও শেওড়াফুলি থেকে তারকেশ্বরে পায়ে হেঁটে জল ঢালতে যাওয়ার উৎসবে ভাটা পড়ে নি। জমিদারির বিপুল আয় সত্ত্বেও তারকেশ্বরে পুণ্যার্থীদের সুবিধা প্রদানের কোন চেষ্টাই এই মোহন্তরা করেন নি। ইংরেজ সরকার, পুলিশ,এবং স্থানীয় গুন্ডাবাহিনীর সাহায্যে দিনের পর দিন প্রজাদের ওপর অত্যাচার করে গেছেন। ১৯২৪ সাল। এসবের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করেন স্বামী সচ্চিদানন্দ। মোহন্তের গুন্ডারা তাঁকে প্রহার করে। জেলার সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের আগুন ব্যাপক আকার ধারণ করে। সাধারণ মানুষের অনুরোধে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস তারকেশ্বরের অনাচার বন্ধের জন্য সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন সুভাষচন্দ্র বসুও। দীর্ঘ চারমাস আন্দোলনের পর আন্দোলন সফল হয়। আদালতের রায় আন্দোলনকারীদের পক্ষে যায়। এক মোহন্তের পর তাঁর শিষ্য মোহন্ত হবেন, এই প্রথার বিলোপ ঘটে। সৎ ও হিন্দু সদস্যদের নিয়ে কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটির হাতেই অর্পণ করা হয় মোহন্ত নির্বাচনের ক্ষমতা।
তারকেশ্বর সত্যাগ্রহের সাথে এভাবেই জড়িয়ে আছেন চিত্তরঞ্জন দাস। তারকেশ্বর মন্দিরের প্রবেশ পথে সম্প্রতি তাঁর নামে এবং সুভাষচন্দ্র বসুর নামে দুটি তোরণ নির্মিত হয়েছে। তারকেশ্বরের মহন্তের সেই ক্ষমতা আর নেই। অনেক অত্যাচার ও কুকীর্তির সাক্ষীস্বরূপ আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মোহন্তর প্রাসাদ। দেশবন্ধুর অন্যতম স্বপ্ন ছিল পল্লীসংস্কার। কিন্তু বড় তাড়াতাড়ি চলে গেলেন দেশবন্ধু। রয়ে গেছে তাঁর স্মৃতি। বাঙালী ইতিহাস বিমুখ, তাই তারকেশ্বরের মানুষের মন থেকেও বোধ হয় হারিয়ে যেতে বসেছেন দেশবন্ধু।