নদীয়ার কৃষ্ণগঞ্জে বুড়ো সাহেবের মাজারে ভক্তরা সামিল মঙ্গলকামনায়

Social

অঞ্জন শুকুল, নদীয়া: নদীয়ার কৃষ্ণগঞ্জের বানপুরে দরগায় পীর সাহেবের মাজারে পূজা দিতে এলেন ভক্তরা। ৭ই আষাঢ় পীর সাহেবের জন্ম ও মৃত্যু দিন সেই উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভক্তের দল ভীড় জমান মাজারে ।

এখানে মানত করলে ফল পাওয়া যায় হাতে নাতে এই বিশ্বাসে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, মুসলমান সকল সম্প্রদায়ের মানুষ নিজের শাস্ত্রমতে পূজা দেন । এলাকাবাসীর দাবি অনেকে মানত করে আর মানত পূর্ণ হলে কেউ দিচ্ছেন মুরগি আবার কেউ দিচ্ছেন ছাগ ও বাতাসা । আবার অনেকে এই ছাগ মুরগি রান্না করে ভক্তদের খাওয়াচ্ছেন । সকল ধর্মের মানুষের একসঙ্গে খাওয়া । এই ঘটনা হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।

জানা যায় প্রজাদের রাক্ষসের হাত থেকে বাঁচাতে ভবানন্দ মজুমদার পারস্য দেশ থেকে পীর সাহেবকে এনেছিলেন । তিনি এই মাটিয়ারীতে আসার পর রাক্ষসরাজকে লাঠি দিয়ে পরাস্ত করে মেরে ফেলেন,কারন তিনি ছিলেন দৈব শক্তি বলে বলিয়ান। এরপর পীর সাহেব পারস্যে চলে যেতে চান কিন্তু রাজা যেতে দেননি । তিনি পীর সাহেবেকে এই স্থানে রেখে দেন ।

এটি এখন বুড়ো সাহেবের মাজার, পাশে জলজল করছে সেই সময়কার লাঠি যে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে রাক্ষসরাজ কে মেরে ছিলেন । পরবর্তীতে ভবানন্দ আরমজুমদারের বংশধর বৃটিশের কাছ থেকে রায় উপাধী পান । সে দিনের পীর সাহেব আজ বুড়ো সাহেবের মাজারে পরিনত । যেখানে থাকতেন সেখানেই সমাধি ইচ্ছা অনুযায়ী পীর সাহেবের।

প্রতি বছর বাংলাদেশ সীমানা সংলগ্ন নদীয়া জেলার প্রান্তিক গ্রাম মাটিয়ারিতে বাবা বুড়ো সাহেবের দরগা কে কেন্দ্র করে অম্বুবাচি তিথিতে মেলা বসে। এবার করোনা অতিমারীর কারণে জনগণের নিরাপত্তার কথা ভেবে মেলা বন্ধ করা হয়েছে। ফলে মানুষের মন খারাপ। এই মেলা সুপ্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে। প্রাচীন ঐতিহ্য মেনে বানপুরের মাটিয়ারী গ্রামে প্রতিবছর এই দিনেই অম্বুবাচিতে মেলা বসে। প্রায় ১৫ দিন ধরে মেলা চলে। এপার বাংলার এবং ওপার বাংলার অসংখ্য মানুষ মেলাতে আসেন। বাবা বুড়ো সাহেবের দরগাতে সিন্নি দেন, মানত করেন, মানত শোধ করতে আসেন। দরগা চত্বর, সামনের পুকুর পার মানুষে ভরে যায়। পীর সাহেবের নামে জয়ধ্বনি ওঠে। বাইরে মাটিয়ারী বাজার জুড়ে রাস্তার দুপাশে খেলার মাঠে দোকান পাট মানুষের ভিড়। মাইকের চিৎকার সব মিলিয়ে দরগা এবং দরগা সংলনগ পরিবেশ জমজমাট হয়ে ওঠে।

যদিও এবারে এসব কিছুই হচ্ছে না। শুধুই স্মৃতি । তবে ভক্তরা এত বিধি নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও প্রায় বাঁধন ছাড়া। ব্যাক্তিগত উদ্যোগে অনেকেই এসেছেন, আসবেন। যতদূর জানা যায় পীর সাহেব মালেক উল গউস মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবনান্দের সময় কালে (১৬০৬-১৬২৮) অম্বুবাচি তিথিতে মাটিয়ারিতে পদার্পন করেন। তিনি সিদ্ধ পীর ছিলেন। তার অলৌকিক ক্ষমতা জানার পর ভবনান্দ তাকে এখনে থেকে যেতে অনুরোধ করেন। দরগার সংলগ্ন স্থানে বসবাসের ব্যাবস্থা করে দেয়। এক সময় তাকে হজরত শাহ মুলুকে উল গউস অর্থাৎ ফকিরের বাদশা উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।

তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। তার তিন শিষ্য । মুসলমান শিষ্য আব্দুল করিম। এছাড়া একজন ছিলেন নাপিত। অন্য জন রজক। দীর্ঘদেহি অপূর্ব লাবণ্য যুক্ত আকর্ষণীয় ব্যাক্তিত্ব ছিলেন। তার ঐশী ক্ষমতার প্রভাবে এলাকা বাসীর চোখের মণি হয়ে উঠেছিলেন। দীর্ঘ দিন এই অঞ্চলের মানুষের সেবায় নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন। ভবনান্দ তার কুটির সংলগ্ন জমিতেই সমাধি নির্মাণ করেন। এই সমাধি ক্ষেত্রটি আজকের দরগা। বাবা বুড়ো সাহেবের দরগা নামে পরিচিতি লাভ করেন। তার এই প্রয়াণ দিবসকেই শ্রদ্ধা জানাতে অম্বুবাচি তিথিতে মাটিয়ারী মেলা শুরু হয়। দরগার অভ্যন্তরে তিনটি সমাধি লক্ষ্য করা যায়। প্রধান উঁচু সমাধিটি বাবা বুড়ো সাহেবের। অন্য দুটি অনুচ্চ সমাধি হলো তার দুই প্রিয় শিষ্য একজন রজক অন্য জন নাপিত। সমাধির পাশে ৫ ফুট দীর্ঘ একটি বাতিস্তম্ভ আছে। ভক্তরা নিয়মিত ধুপদ্বীপ জ্বালান। সমাধির অভ্যন্তরে একটি পুরোনো নিম গাছ ছিল । আজ আর নেই। পরিবর্তে আর একটি বয়সে তরন নিম গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সকলেই এই সমাধি ক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে বাবার কাছে দোয়া প্রার্থনা করেন। এলাকা বাসীর কাছে এই দরগা আধ্যাতিক আশ্রয় কেন্দ্র। বাবা বুড়ো সাহেবের দোয়া সকলের উপর অকৃপণ ভাবে বর্ষিত হচ্ছে। মেলার সময় বাবার ওপর নির্ভরতা কত খানি তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দর্গার প্রবেশ পথে দুধারে আউল বাউল দরবেশেরা সারি বদ্ধ ভাবে বাবার জয়গানে মুখর হয়ে ওঠে। কোনো উদাসী বাউল একতারা বাজিয়ে গেয়ে ওঠে । সর্ব লোকে কয় লালন কি জাত এই সংসারে।

Leave a Reply