নিউজ সোশ্যাল বার্তা, ২৭শে নভেম্বর ২০১৯, সঞ্চিতা মন্ডল: নীল নদের উপর ক্রুজে রাত্রি যাপন করার পর অতঃপর সকাল হয়ে ভোরের আলো তখন জানালা দিয়ে প্রবেশ করার মুখে। দেখি ক্রুজ নদীর তীরে দাড়িয়ে আছে। ঘড়িতে তখন সকাল ৫ টা ১০মিনিট। তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে হাজির হলাম ক্রুজের লবি তে। ক্রুজ থেকে বেরোনোর সময় সেই কার্ড টি দিল। যে কার্ডটি ছাড়া ক্রুজ এ কিন্তু ঢুকতে দেবে না। দুটো ক্রুজ পেরিয়ে পৌঁছালাম নদীর তীরে। রাস্তাতে আমাদের জন্য ঘোড়ার গাড়ি অপেক্ষা করছে। ঘোড়ার গাড়িতে করে যাবো আজকে Edfu Temple।
ঘোড়ার গাড়িতে উঠে বসলাম। টুর ম্যানেজার আগে থেকেই বলে দিয়েছিল ঘোড়ার গাড়ির নম্বর দেখে রাখতে। ঘোড়ার গাড়ির চালক এর সঙ্গে কথা বলতে বলতে গেলাম। খুব ভালো ইংলিশ বোঝে না। বোঝার চেষ্টা করলাম তার কথা গুলো। সে তার ঘোড়ার সঙ্গে খুব ভালো করে ছবিও তুলে দিলো। ওখানকার সব মানুষ দের এটা নীতি বলা যেতে পারে টিপস চাওয়া। আমরা কিছু টিপস ঘোড়ার গাড়ির চালক কে দেয়নি। টুর ম্যানেজার বারন করে দিয়েছিল। মন্দিরের টিকিট হাতে ধরিয়ে দিল । ঢুকলাম মন্দিরের ভেতর। একই টাইপের মন্দির এর আদল।আর মন্দিরের গায়ে হায়ারোগ্লিফি তে লেখা। গাইড খুব বোঝাতে শুরু করলো। আমাদের গ্রুপ এর অনেক এ খুব বোঝার চেষ্টা করলো । আমি সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম সবাই যে বিরাট কিছু বুঝছে তা নয়! আমি আবার ছবি তুলতে শুরু করে দিলাম। টুর গাইড বলে দিল ৭ টা’র মধ্যে মিটিং পয়েন্ট এ চলে আসতে। আমরা ঘুরে ঘুরে মন্দিরটি দেখতে শুরু করে দিলাম । তারই মধ্যে এক চিনা মেয়ের সঙ্গে একটু বচসা হয়ে গেলো। চিনা মেয়েটি চাইছে আমরা একটি ছবি তুলে চলে আসি মেয়েটি সেই জায়গাতে অনেক ছবি তুলবে । সেটা তো আর হতে দেওয়া যায় না। চীন দেশের মানুষের ব্যবহার আমার মনে হয় পৃথিবীর সব মানুষ দের থেকে খারাপ । যাই হোক সময়ের মধ্যে এসে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে বসলাম।রাস্তায় দেখলাম এক জায়গাতে সার্কাস হচ্ছে। ক্রুজ এর কাছে নামলাম। ক্রুজ ছেড়ে বেরিয়ে যাবে ৭.৩০ মিনিটে। ক্রুজে ওই কার্ডটি দেখিয়ে ঢুকলাম। ক্রুজে ঢুকে ব্রেকফাস্টে গেলাম। ব্রেকফাস্ট কন্টিনেন্টাল। টুর ম্যানেজার বলে দিয়েছিল রুমে না কাটিয়ে যত টা সম্ভব সময় ক্রুজের ডেকে কাটানোর কথা। ঠিক ১১ টার সময় ক্রুজ পেরোবে এসনা লক গেট । কথা মত আমরা ব্রেকফাস্ট সেরে ডেকে পৌঁছালাম। ডেকে সুইমিং পুল থেকে শুরু করে সুইমিং পুল এর ধারে শুয়ে থাকার চেয়ার সব আছে। বসলাম গিয়ে ডেকে। সূর্যের আলো তার সঙ্গে নীল নদের ঠান্ডা হাওয়া।
দুচোখ ভরে দেখতে লাগলাম ভূগোল বই এর পাতায় পড়া নীল নদ কে । ক্রুজের ধার দিয়ে যাচ্ছে অনেক নৌকা । ওখানকার লোকেরা ওই নৌকা থেকেই জিনিস বিক্রি করছে- বিভিন্ন চাদর সামগ্রী ক্রুজের লোকেদের কাছে । পছন্দ হলে ওরা ওই নিচ থেকে ক্রুজের উপর দিকে ছুড়ে দিচ্ছে। এই সব দেখতে দেখতে আমার চোখ বুজে গেছে। চোখ খুলে দেখি তখন ডেকে অনেক লোকজন চলে এসেছে। সময় তখন ১০.৪৫.. বুঝলাম আমরা এসনা লক গেট এর কাছাকাছি চলে এসেছি। এসনা লক গেট এর বিশেষত্ব হলো – লক গেটের এক দিকে নদীর জলতল টি উঁচু আরেকদিকে জল তলটি নিচু। আমাদের ক্রুজ টি উঁচু থেকে নিচু দিকে যাবে। এসনা লক গেট এর কাছাকাছি এসেছি। ক্রুজটি পেরোবার জন্য একটা সরু জায়গা দিয়ে ঢুকতেই দড়ি দিয়ে পাড়ে বাঁধলো। তারপর লক গেট টি খুলে দিল এবং পাম্প দিয়ে জল তলটি সমান করে দিয়ে আমাদের ক্রুজটি কে পারাপার করতে দিল। লক গেটের উপরে হাইওয়ে অনেক গাড়ি চলাচল করছে।
এইসব দেখে ফটো তুলে ১২ টা নাগাদ পৌঁছালাম ডাইনিং হলে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য। একই ধরনের দুপুর এর খাবার খেয়ে রুমে গেলাম। তখন সময় দুপুর ২ টো। আমাদের ক্রুজ গন্তব্যে পৌঁছে গেছে । জায়গার নাম Luxor। রুমে ফ্রেশ হয়ে ৩.৩০ নাগাদ আবার ডেকে গেলাম। চা দেওয়া হয় ক্রুজের ডেকে ওই ৩ টে থেকে ৩.৩০ অব্দি। চা খেয়ে পৌঁছালাম আবার ক্রুজ এর রিসেপশনে । আজকে বিকেলে যাবো মিশর এর বিখ্যাত পাপাইরাস মিউজিয়াম আর Luxor Temple।
পৌঁছালাম প্যাপিরাস ফ্যাক্টরি তে। আমাদেরকে আবার ওখানে ওয়েলকাম পানীয় হিসাবে দিল সেই জবা ফুল এর পানীয়। এইবার একটি ইজিপশিয়ান মহিলা ওখানে কর্মরত বোঝাতে শুরু করলো এবং তার সঙ্গে সঙ্গে দেখালো কিভাবে প্যাপিরাস গাছের ছাল থেকে কিভাবে প্যাপিরাস পাতা তৈরি করা হয়। দেখলাম ওই ফ্যাক্টরি তে প্যাপিরাস ওই পাতার উপর খুব সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকা আছে। তার মূল্য অনেক তবে কিনলো। অনেকেই । নিজের নাম ওই আঁকার উপর হাইরোগলিফি অক্ষরে লেখাতে গেলে আলাদা চার্জ দিতে হবে। প্রতি নাম পিছু ৫০ পাউন্ড। আমি আমার দিদি ছোট একটি করে পেন্টিং কিনলাম। কায়দা করে আমি আর দিদি চারটে নাম হায়রোগ্লিফি তে লেখলাম। কিন্তু ওদেরকে বললাম এই পুরো নামটা একটাই নাম। ওরাও তাই বুঝলো। তবে ওই প্যাপিরাস ফ্যাক্টরি তে দাম খুব গন্ডগোল ।কেও বিরাট বড়ো পেইন্টিং কিনেছে কমে কেউ ছোট আঁকা কিনছে বেশি দামে। জিজ্ঞাসা করলে বলছে সব আঁকা তো একই আর্টিস্ট এর নয় তাই।
এইখান থেকে বেরিয়ে পৌঁছালাম সন্ধ্যের সময় Luxor টemple এ।লাইটিং এর জন্য দেখতে মন্দির টিকে অপূর্ব লাগছিল। কিন্তু মন্দিরটি একই রকমের Luxor Temple, এর ওখানে দেখলাম প্যাপিরাস বিক্রি করছে। টুর গাইড বললো ওইগুলো আসল নয়। ওইগুলো নাকি কলা পাতা দিয়ে তৈরি । যাই হোক মন্দিরটি ভালো করে ঘুরে ছবি তুলে বাসে এসে বসলাম। বাস ছাড়ল। টুর ম্যানেজার পরের দিন এর প্রোগ্রাম বলতে শুরু করলো। শুনেই চোখ কপালে! টুর ম্যানেজার বলল যাদের বেলুন রাইড আছে তাদেরকে উঠতে হবে ভোর তিনটে। শুনে মনে হলো কেনো বেলুন রাইড এর জন্য হ্যাঁ করলাম । যাক মনে ফুর্তি ও লাগলো যে কালকে বেলুন রাইড করবো জীবনে প্রথম বার। যারা বেলুন রাইড করবে না তাদের উঠতে হবে ভোর পাঁচটা তে। বেলুন রাইড করলে ব্রেকফাস্ট হবে প্যাকেট । বাস এসে পৌঁছল ক্রুজ এর সামনে। ক্রুজ এ ঢুকে আমাদের পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে দিল। আমরা ডিনার করে রুমে ফিরলাম। সব গুছিয়ে নিলাম। । আজকের রাত আমাদের ক্রুজ এ শেষ রজনী। মন খারাপ এত সুন্দর ক্রুজ জার্নি শেষ হয়ে গেলো বলে। সব কিছু ব্যাগ গুছিয়ে একটু ডেকে গেলাম। শেষ বারের মত রাত্রের সুন্দর নীল নদ কে আলিঙ্গন করতে। ডেক থেকে এসে ঘুমের দেশে পাড়ি।( ক্রমশ)