গাজন কথার মানে কি ? ভাঁটা চিরাচরিত গ্রাম বাংলার গাজন উৎসবে

Social

মলয় দে, নদীয়া:- “আমরা দুটি ভাই শিবের গাজন গাই, ঠাকমা গেছেন গয়া কাশি ডুগডুগি বাজাই । ”

শুরু হলো গ্রাম বাংলার চিরা চরিত প্রথা অনুযায়ী গাজন উৎসব । সাধারণভাবে ” গা ” শব্দের অর্থ গ্রাম এবং ” জন ” শব্দের অর্থ জনসাধারণ । অর্থাৎ এককথায় বলা যায় গাজন বাংলার জনসাধারণের একটি উৎসব । সেই কারণেই এর এইরূপ নামকরণ । অপর আরেকটি মতে বাংলায় গাজন শব্দটি এসেছে “গর্জন” শব্দটি থেকে । বলা হয়ে থাকে উক্ত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ কারী সমস্ত সন্ন্যাসীরা প্রচন্ড গর্জন করেন বলেই এই অনুষ্ঠানের নাম গাজন ।

গাজন পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলা দেশে পালিত একটি হিন্দু লোক উৎসব । এটি শিব , নীল , মনসা ও ধর্মঠাকুরের পুজো কে কেন্দ্র করে বিশেষ একটি অনুষ্ঠান । বাংলার কিছু অঞ্চলে এটি সমস্ত চৈত্র মাস ধরে পালিত হয় আবার বেশির ভাগ অঞ্চলে চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ ধরে সন্ন্যাসী বা ভক্তদের মাধ্যমে উক্ত অনুষ্ঠান পালন করার রীতি বিরাজমান রয়েছে । গাজন অনুষ্ঠানে দুজন শিব ও গৌরী সেজে ও অন্যান্যরা নন্দী , ভৃঙ্গী , ভূত প্রেত ও অন্যান্য দৈত্য দানবের সং সেজে নিজেদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে যন্ত্রণা দিয়ে কৃচ্ছ সাধনের মাধ্যমে দেবাদিদেব কে সন্তুষ্ট করার প্রয়াস চালান , এমনকি এরা সং সেজে বিভিন্ন নৃত্য ক্রিয়াতেও অংশ গ্রহণ করে থাকেন ।

লোকবিশ্বাস অনুযায়ী গাজন উৎসবের দিনে দেবী হরকালির সাথে শিবের বিবাহ হয় । বিবাহ উৎসবে সন্ন্যাসীরা বর যাত্রী হিসাবে অংশ নেন অন্যদিকে ধর্ম ঠাকুরের গাজন হলো ধর্ম ঠাকুর ও দেবী কামিনী কামাখ্যার দেবী মুক্তির বিবাহ উৎসব । শিবের গাজন , ধর্মের গাজন , নিলের গাজন , আদ্যের গাজন প্রভৃতি বিভিন্ন শ্রেণীতে এই উৎসবকে ভাগ করা যায় । আবার অপর আর একটি মতে সূর্যের সাথে পৃথিবীর বিবাহ দেবার অনুষ্ঠান এই গাজন অনুষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য বলেও কিছু শ্রেণীর মানুষের ধারণা ।

প্রাচীন ইতিহাস সূত্রে জানা যায় চৈত্র মাস থেকে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্য যখন প্রবল অগ্নিময় রূপ ধারণ করে তখন সূর্যের তেজ প্রশমন ও বৃষ্টির আশায় কৃষিজীবী সমাজ এই অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করেছিলেন । প্রধানত ,গ্রাম্য শিব মন্দির কে কেন্দ্র করে এই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় । গাজনের সময় শিব প্রকৃত অর্থে গণদেবতা । প্রত্যেকেই সমমর্যাদায় শিবের উপাসনা করেন । গ্রামাঞ্চলে অনেক সন্ন্যাসী ই তাদের গালে কাঁটা বা শিক ফুটিয়ে , আগুন ও কাঁটার ওপর দিয়ে হেঁটে এবং সারাদিন আহার না করে উপবাস থেকে এবং চৈত্র সংক্রান্তির দিন অর্থাৎ মাসের শেষ দিন নিজের পৃষ্ঠ দেশে বর্শি বিঁধিয়ে চড়ক উৎসবে অংশ গ্রহণ করেন । এই সময় অনেক মানুষ চড়কের সন্ন্যাসীকে ফলাহার করান , অনেকেই তাদের শিশুকে চরকের সন্ন্যাসীর কোলে তুলে দেন এবং জনশ্রুতি অনুযায়ী পুণ্য অর্জনের চেষ্টা করেন । বলা যায় চৈত্র মাসের শেষে অর্থাৎ সংক্রান্তির দিনেই তাদের সমস্ত ব্রত ভঙ্গ করেন । আবার চরক সংক্রান্তির ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও সেখানে সময়মতো জমির খাজনা না দেবার কারণ বশত বাংলার নিষ্ঠুর জমিদার কর্তৃক প্রজাদের শূলে চড়ানো র মর্মান্তিক কাহিনী র ইতিহাস জানা যায় । গতবছরের লকডাউন হওয়ার পর গ্রাম বাংলার এই ধর্মীয় সংস্কৃতি, অনেকটাই ভাঁটা পড়ে, এ বছরও তা অতিক্রম করে খুব বেশি স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি।

Leave a Reply