সুমো’ হওয়ার আগ্রহ বাড়ছে জাপানে

Social

প্রীতম সরকার: ‘সু’ অর্থাৎ ‘ফেলো’, মানে প্রতিপক্ষ এবং ‘মো’ অর্থাৎ ‘ষ্ট্রাইক’ মানে আঘাত করা। সুমো রেসলিং অর্থাৎ সুমো কুস্তি। দু অক্ষরের সামান্য একটি লড়াই প্রতিযোগিতা। কিন্তু চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত, কী অবিশ্বাস্য শক্তির প্রদর্শনী বা প্রতিযোগিতা এই কুস্তি কেরামতি। দেড়শো- দুশো- আড়াইশো কেজি ওজনের এক একজন মানব দৈত্য নিমেষে প্যাঁচে পরাস্ত করে, প্রতিপক্ষকে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন রিঙের বাইরে। যাঁর যত শক্তি, সেই হবেন চ্যাম্পিয়ন। এই কুস্তিগিরদের বয়স আঠারো, কুড়ি বা বাইশ। জাপানের সব চাইতে জনপ্রিয় বিনোদন মাধ্যম এই সুমো কুস্তি। সুমো কুস্তি বা কুস্তিগিরদের দেখবার জন্য বা তাঁদের স্পর্শ পাওয়ার জন্য পাগল জাপানের বাচ্চা বুড়ো থেকে যুবক যুবতী। ছ’ফুট উচ্চতার বিশাল আকারের বিশ্ময় মানুষগুলোর লড়াই দেখতে দেখতে বহু জাপানি যুবকই এখন ক্রমশ আগ্রহী হয়ে পড়ছেন সুমো কুস্তিগির হওয়ার জন্য।

আসলে জাপানের দেড় হাজার বছরের পুরানো এই সম্পূর্ণ শরীরী শক্তি লড়াইয়ের খেলার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সে দেশের প্রাচীন ধর্ম, ধর্মীয় আচার-বিচার। বস্তুতঃ সুমোর শিকড় ঢুকে রয়েছে দেশের ধর্মের আস্তরণে। কথিত আছে, মহান দেবতা তাকো-মিকাজুচি-র সঙ্গে মহা লড়াই জমে উঠেছিল প্রচন্ড শক্তিধর এক উপজাতির সর্দারের। শক্তিশালী দুই যোদ্ধার লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত জয় হয় দেবতার। তারপর থেকেই সুমো লড়াই উৎসর্গিত হয় দেশের পরম ঐতিহ্যময় দেবতার নামে। শরীরী কুস্তি লড়াই ধর্ম মেনে, তাকে-মিকাজুচির বিজয়োৎসব দেখাতে দেখাতেই জন্ম হয় আজকের সুমো লড়াইয়ের। দিনে দিনে নিয়মের বদল হলেও এখনও ধর্মীয় আচার বিচারের সঙ্গে সুমো লড়াইয়ের বহু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। লড়াই প্রদর্শনীর আগে গ্র্যান্ড চ্যাম্পিয়ন কোমরে যে ধরনের দড়ি বা কাছি জড়িয়ে কুস্তির মঞ্চে আসেন, সেই একই দড়ি ঝুলতে দেখা যায় জাপানিদের যে কোনও ধর্মীয় অনুষ্টানে।

জাপানে সুমোর পেশাদার প্রদর্শনী শুরু চোদ্দশো শতকে। জাপানের প্রাচীন ছবি, ভাস্কর্য বা ঐতিহাসিক প্রমানাদি থেকে জানা যায়, এই কুস্তিগিররা সবসময়েই আর পাঁচজান সাধারন মানুষের চেয়ে পাঁচগুন বেশি শক্তিশালী। সুমোর আকার আকৃতি স্বভাবতই অনেক বড় মাপের। পরনে তাঁদের লয়েনক্লথ বা কটিবস্ত্র। চুল টপ নট করা। অর্থাৎ মাথার উপর চুড়ো করে চুল বাঁধা। উনবিংশ শতকে জাপান যখন নিজেকে আধুনিক বিশ্বের দরবারে উন্মুক্ত করে, তখনই সরকারি শাসক মেইজি-র আদেশে টপ নট নিষিদ্ধ করা হয় দেশে। আদেশ দেওয়া হয়, একমাত্র সুমো কুস্তিগির ছাড়া কেউ চুল টপ নট রাখতে পারবেন না। এমনকি, যদি কোন সুমো কুস্তিগির মাঝ পথে কুস্তি ছেড়েও দেন, তাঁকে চুলের টপ নট কেটে ফেলতে হবে। সাধারনত সুমো কুস্তিগিররা তাঁদের বিশাল চেহারার কারনে আলখাল্লাজাতীয় পোষাক ‘উকাতা’ পরে চলাফেরা করেন।
শরীর-শক্তির এই অসাধারন দক্ষতা দেশের স্বার্থে ব্যবহৃত হয় মিলিটারি শাষক ইয়োশিতসুনের আমলে। খালি হাতে শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য। কয়েকটি জুজুৎসু প্যাঁচের সংমিশ্রনে সুমোর মারপ্যাঁচ সেই সময় থেকেই আরও উন্নত হয়ে ওঠে।

অনেকের ধারনা বিশাল চেহারার সুমো কুস্তিগিররা হয়তো ব্যাপক পরিমানে খাওয়াদাওয়া করে থাকেন। কিন্তু এই ধারনা একেবারেই ভুল। মাছ-মাংস তো দূরের কথা, মাখন খাওয়াও তাঁদের মানা। শুধুমাত্র এক বিশেষ ধরনের প্রোটিন ডায়েট খাইয়ে এঁদের সুমো কুস্তির স্বার্থে বিপুলাকার চেহারার করে তোলা হয়। ডায়েট তালিকায় অধিকাংশ সুমো কুস্তিগিরদের সবচেয়ে পছন্দের স্টু হচ্ছে- ‘চানকোনাবে’। ডায়েট খাবার খেয়েও সাধারনত সুমো কুস্তিগিরদের গড় আয়ু ষাট থেকে পয়ষট্টি বছর। স্বল্প ডায়েটের সঙ্গে আখরায় সুশৃঙ্খল সংযত জীবনযাপণ একজন সুমো কুস্তিগির তৈরি করে।

শুধু জাপান নয়, সুমো টুর্নামেন্ট হয় ইংলন্ড, আমেরিকায়। ইংলন্ডে হয় ‘ কাপ ফাইনাল ’ আর আমেরিকায় ‘ ওয়র্ল্ড সিরিজ ।’ তবে বেশি টুর্নামেন্ট হয় জাপানের টোকিও শহরে। সেখানে প্রায় পনেরো দিন ধরে চলে এই টুর্নামেন্ট। সুমো খেলায় গ্র্যান্ড চ্যাম্পিয়ন বা সব্বোর্চ জয়ীকে বলা হয় ‘ইয়েকোজুনা’। পরের স্থান বা চ্যাম্পিয়ন ‘ওকেজি’। এরপরেও থাকে আরও তিনটি পদ – ‘সেকিওয়াকে’, ‘কোমুসুবি’, ও ‘মাইগাশিরা’। সব শেষের পদ হলো ‘বানজুকে’। মাটি থেকে দুই ফুট উঁচুতে ১৫ ফুট ব্যসার্ধের চৌকো ‘দোহিয়া’ (যে মঞ্চে সুমো কুস্তি হয়) সেটা তৈরি হয় কাদামাটি আর বালি দিয়ে। সেই মঞ্চেই সুমো কুস্তিগিররা একে অন্যকে রিংয়ের বাইরে পাঠানোর আপ্রান চেষ্টা করে যান।
যার চেহারার আকার যত বড় তাঁর আয় তত বেশি। যার যত শক্তি, তাঁর অর্থ তত বেশি। কল্পনার বাইরে সুমো রেসলারদের আয়ের পরিমান।

দিনে দিনে এই কুস্তিগিরদের আয় বেড়েই চলেছে। একজন উচ্চপদস্থ সুমো কুস্তিগিরের মাসিক আয় কমপক্ষে প্রায় ২৫ হাজার ডলার। নিম্নপদের রোজগার কমপক্ষে ১০ হাজার ডলার। এছাড়া রয়েছে টুর্নামেন্ট কমিটি বা ফ্যানদের থেকে পাওয়া উপহার। তা সে ডলার বা লক্ষ লক্ষ ইয়েন হোক বা হিরে বসানো এপ্রন। আর সেই সঙ্গে আছে খ্যাতি। বিশ্বের যারা মহা তারকা, তাঁরাও সুমোদের একবার চোখে দেখার জন্য হন্যে হয়ে থাকেন। জাপানের লোকজন তো মনে করেন, সুমোদের স্পর্শ করা মহা পূণ্যের কাজ। এই কারনে দিনে দিনে জাপানে বেড়েই চলেছে সুমো হওয়ার আগ্রহ।

Leave a Reply