তক্তপোশের নীচে সুসাইড নোটটা রেখে; অতি সাবধানে খাটের ওপর চেয়ারটা তুলে নিলেন। আস্তে আস্তে গলায় ফাঁসটি লাগিয়ে… কী যেন চিন্তা করলেন ; তারপর বারদুই মাথা ঝাঁকিয়ে পা -দিয়ে ঠেলে চেয়ারটা সরিয়ে দিলেন। …….
পরদিন সকালে বাড়ির সকলে যখন নিজনিজ ব্যস্ততায় মগ্ন তখন বাড়ির সর্ব কনিষ্ঠ দাদুর নেওটা-টির বিকট হাসিতে বিরক্ত হয়ে সবাই কারন খুঁজতে গিয়ে দেখল, সে দাদুর পা ধরে দোলাচ্ছে আর বলছে “দোল দোল দুলুনী দাদুর টাকে চিরুনি ”
এভাবেই রবীন বাবু ইহলোক ত্যাগ করলেন।
সান্যাল বাড়িতে নেমে এল অকাল শোকের ছায়া, কারন রিটেয়ার করলেও রবীন বাবু বেশ মোটা অঙ্কের পেনশন পেতেন। এরপর যা হয় কদিন কান্নাকাটি, লোক দেখানো শোক ; আর তারপর ফটোর রজনীগন্ধা শুকিয়ে যাবার আগেই রবিন বাবু পাততাড়ি গোটালেন সান্যাল বাড়ির স্মৃতি থেকে।
বেশ কিছুমাস পর, হঠাৎ একদিন তক্তোপোষের নিচে কিছু একটা খুজঁতে গিয়ে রবিনবাবুর বড় নাতনি চিরকুটটি পায়। একটাই কথা লেখা ছিল তাতে “৭৫ এর খোলসে ২৫ কেন ? ” কৌতূহলটা বাড়ত না,যদি না তাতে রবিন বাবুর মৃত্যু তারিখ এবং সময়টা লেখা না থাকত।
ইশিতা সেদিন কাওকে কিছুই বলে নি ; তবে কিছু একটা ব্যপার যে দাদুর মৃত্যু ঘিরে রয়েছে এবং সেটা বাড়ির কেউ এমনকি পুলিশও ধরতে পারেনি, সেটা সে বুঝতে পারে। এদিকে বাড়ির সকলে দাদুর প্রতি যেরকম উদাসীন তাতে তাঁদের কিছু জানিয়ে লাভ নেই, আবার পুলিশকে বলতেও ভয় হয় ; কারন দাদানের মৃত্যুর কারনে যে কদিন পুলিশ এসেছিল তাতে সে দেখেছে, পুলিশ চলে যাবার পর ওর বাবা, কাকারা ” এ বাড়িতে পুলিশ ? পরিবারের সন্মান সব গেল ” বলে যেভাবে দাদানকে গালমন্দ করছিল ; তাতে আবার যদি তাঁরা আসেন, তাহলে কী পরিনাম হতে পারে ভেবেই ওর রক্তহীম হয়ে আসে।
কদিন এভাবেই কাটে, পড়াতে মন বসছে না মাথার ভীতর সারাদিন একটা গুবরে পোকা যেন ভোঁভোঁ করছে। শুধুই মনে হচ্ছে কিছু তো একটা ব্যপার আছে ? ক্রমে ওর ধারনা হল, দাদানের ঘরেই আছে এই রহস্যের চাবিকাঠি । ঐ ঘটনার পরথেকে রবিন বাবুর ঘরটি বন্ধই থাকত
” বাপি এখন তেকে আমি দানানের ঘরে পড়বো।” “বেশ তো “,তবে ঘরটা একটু পরিস্কার করেনিস। ”
রথিন বাবু মেয়ের হাতে চাবিটি দিয়ে অফিস চলেযান। ইশিতা যেন হাতে চাঁদ পেল ! পড়ার ফাঁকে সে ভালো করে খুঁজতে থাকে কিছু যদি পাওয়া যায়, সে তখন যেন লেডি শার্লক হোমস। বেশ কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন ওর হাতে এল রবিনবাবুর লেখা ডায়েরি। প্রচন্ড উত্তেজনায় ওর সমস্ত শরীর কাঁপছে, কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ডায়েরির প্রথম পাতাটি খোলে। মুক্তর মতো হাতের লেখা, প্রথম পাতা জুড়ে বড়ো করে লেখা ” বহতা নদী “। বোধহয় এভাবেই রবীনবাবু তার অটবায়োগ্রাফিটার নাম দিয়েছিলেন । ধীরে ধীরে পরের পৃষ্ঠাটা ওলটায় ….” আজও চারিদিকে ধোঁয়া। তোমর মনে আছে? বিয়ের রাতে যজ্ঞে খৈ দেবার সময় ধোঁয়ায় তোমার চোখ জ্বলছিল, আমি পেছনে দারিয়ে ফু দিচ্ছিলাম যাতে ধোঁয়ারা তোমায় ছুঁতে না পারে। আর আজ দেখো তোমার শরীরটা আমার চোখের সামনে একটু একটু করে ধোঁয়ায় মিলিয়ে গেল,আর আমি শুধু চেয়ে দেখলাম। ” নিচে দিদার মৃত্যুর তারিখ।
ইশিতার মনে পরে কিছু টুকরো ছবি, সেবার দাদানের অফিস পিকনিকে ইলিশ মাছের মেনু হয়েছিল। দিদার ভীষণ প্রিয় ছিল ইলিশ…দাদু রুমালে করে একপিস নিয়ে এসেছিল দিদার জন্য।আর তাই নিয়ে মা, কাকীমারা খুব পেছনে লেগেছিল দিদার। ইশিতার চোখের কোনটা চিকচিক করে ওঠে।
এরপর বেশকিছু পাতা জুড়ে বাড়ির সদস্যদের নিয়ে লেখা নানা কথা যেগুলো বেশিরভাগই ইশিতার অজানা। হঠাৎ একটা পাতায় চোখ আটকে যায়। রঙিন কালিতে লেখা ১২ ই জুলাই ….আরে এতো “আমার জন্মদিন “,অস্ফুটে বলে ওঠে সে। ডায়রি টা টেবিলে রেখে দরজাটা ভালোকরে বন্ধ করে আসে। অজানা আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছে সমস্ত শরীর। ” গতকাল রাত থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি নাগাড়ে পরে চলেছে, সকাল হলেও সূর্য মুখ লুকিয়ে রয়েছে ধুসর মেঘের আঁচলে। তবু আজ ১২ ই জুলাই, আমার বড়ো নাতনি ইশিতার জন্মদিন। আনন্দ আর আশঙ্কায় সময় কাটাচ্ছি একবার মন বলছে তুমি আজ আসবেই পরক্ষণেই মনে হচ্ছে না …মেঘ বোধহয় সূর্যের মতো আমার চাঁদ কেও আমার কাছ থেকে আড়াল করে রাখবে আজ। বাড়ির সবাই ভীষণ খুশী; বড় বৌমা সকাল থেকেই রান্নাঘরে ব্যস্ত, নিতীশ আফিস ছুটি নিয়ে ঘরের ডেকোরেশন করছে, বাকিরা ওকে নানাভাবে সাহায্য করছে। আলো কম থাকায় সন্ধ্যাটা আজ একটু তাড়াতাড়িই হয়ে গেল ; আমন্ত্রিত-রা একে একে আসতে শুরু করেছেন। সাউন্ড সিস্টেমে চলছে চটুল হিন্দি গান, আমার চাতক মন এক দৃষ্টে তোমার পথ চেয়ে। বুকের ভেতর চলছে কবিগুরুর বিক্ষ্যাত সেই গান “মম চিত্তে নিতি নৃত্যে ” ইতিউতি তোমায় খুঁজছি, হঠাৎ কানের কাছে একটা মিষ্টি শব্দ “কেমন আছেন? ” ফিরে দেখি তুমি.. অপলক চেয়ে রইলাম ! ঈশ্বর শুধু হিমানির নিস্তব্ধতা কিংবা সমুদ্রের নৈসর্গিক তরঙ্গ কল্লোল সৃষ্টি করেন নি ; তিনি তোমায়ও গড়েছেন। আজ পড়েছিলে স্যফরন রঙের সালোয়ার, স্বপ্নলোক থেকে আসা কোনো কিন্নরী যেনো। তোমায় দেখছি আর হারিয়ে যাচ্ছি দূর থেকে দূরে , এমন সময় তুমি একটা প্রনাম করলে ; আশির্বাদের ছলে ছুঁয়ে গেলাম তোমার অমন সুন্দর চিবুক , রেশমি চুলে ডুবিয়ে নিলাম আমার কম্পিত আঙুল গুলো। নিতান্ত সাদামাটা কিছু প্রশ্ন করলে, কতক কানে পৌছোল কতক শুনতেই পেলাম না, তবু ঘাড়নেড়ে উত্তর দিলাম। এমন সময় কেক কাঁটা শুরু হল।
“পরে কথা হবে ”
আবার একবার প্রনাম করে তুমি এগিয়ে গেলে। ”
ইশিতা তারাতাড়ি মোবাইলটা খুলে ওর জন্মদিনের ছবি গুলো বেড়করে।
“ঐশী …এতো ঐশী ”
তারমানে ঐশীকে দাদু ….না না তা কেমন করে হয়, আঁতকে ওঠে ইশিতা। ডিসেম্বরের ঠান্ডাতেও ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। দ্রুত পৃষ্ঠা ওলটায় ….
” আজ আর ঘুম আসবে না, তোমার পেলব ঠোঁটের ছোঁয়ালাগা কাচের গ্লাসটি নিয়ে বসে আছি। জানি এটা ছেলেমানুষি, কিন্তু কী করব? বুড়ো বোলে যে আমার গায়ে জোছনা লাগে না তা তো নয় ! বুড়ো বোলে রবি ঠাকুরের যে গান একসময় হৃদয়ে আলোড়ন তৈরী করত, এখন আর তা আমায় স্পর্শ করবে না তা কী হয় ? শুধুমাত্র বুড়ো বলে কী তোমার নরম কোলে মাথা রাখার কোন অধিকার নেই আমার।” ছোটবেলা থেকে দেখে আসা দোরদন্ড প্রতাপশালী মানুষটির মধ্যে যে এমন একটি রোমান্টিক মন গুমরে ছিল কোনদিন কেউ সতার আঁচ পায়নি। আজ ওর দাদানের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে,আচ্ছা ঐশী কী জানত ?
” বেশ কদিন ধরে ভাবছি তোমার থেকে দূরে থাকব।কী ভাববে; যদি সবাই জানতে পারে। এই বয়সে লজ্জায় একেবারে মাথাকাটা যাবে। কিন্তু পারছি কোথায় ?এক দুর্নিবার আকর্ষণে ক্রমশ যেন তোমার মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছি। ভেতরে ভেতরে বেশ টের পাচ্ছি বছর ২৫ এর বেপরোয়া রবীনটা ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে চাইছে , সে চাইছে সমস্ত বাঁধার পাহাড় সরিয়ে তোমায় নিবিড়ভাবে পেতে। কিন্তু না কোনভাবেই আমি ওকে বেড়িয়ে আসতে দেবো না।আমর এতো যত্নে গড়া সামাজিক সন্মান আমি কিছুতেই নষ্ট হতে দেবো না। জানো ঐশী বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের খোলস টাও মোটা হয় ! আমরা তো সাপ নই তাই খোলস ত্যাগ করতে পারিনা ; না’হলে হয়ত এতদিনে ২৫ এর রবীন-টাকে আটকাতে পারতাম না। আজ খুব প্রানভোরে নিশ্বাস নিতে ইচ্ছে হচ্ছে, যাতে শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তোমার গন্ধ নাকে লেগে থাকে। ” ২০ শে জুলাই, রাত্রি ২:৩৫ মি.।
ইশিতা দুহাতে নিজের মুখ ঢাকে, বাইরে একটা কাক নাগাড়ে ডেকে চলেছে, বোধহয় ভোর হল।