মলয় দে নদীয়া :- শাস্ত্র মতে দুর্গম অসুরকে বধ করেছেন যে অষ্টাদশভূজা দেবী — তিনিই ‘দুর্গা’। শ্রীশ্রী চণ্ডী গ্রন্থে আছে দুর্গম অসুরকে বধ করেন বলে দেবীর নাম হয়েছে দুর্গা। মহিষাসুরকে যে দেবী বধ করেছেন তাঁর নাম মহিষমর্দিনী চণ্ডী। তিনি দুর্গতি নাশ করেন ও সকল শক্তির সম্মিলিত রূপ তিনি, তাই তাঁকে ‘দুর্গা’ নামে পূজা করা হয়।
দেবী ভাগবত পুরাণ অনুসারে ঋষি বিশ্বামিত্র কুমার কার্তিক এবং গণেশকে প্রশ্ন করেন যে তাদের মাতার নাম দুর্গা কেন ? দেবী ভাগবতে বলা হয়েছে হিরণ্যাক্ষ এর বংশে রুরু নামক এক অসুর ছিলো। প্রজাপতি ব্রহ্মার সে ঘোর তপস্যা করছিলো অরণ্যে। বহুকাল অতীত হলেও ব্রহ্মা দর্শন দিলেন না। সেই অসুরের উগ্র তপস্যা এত উচ্চে চলে গিয়েছিলো যে তার শরীর থেকে তপাগ্নি তে তপোবন পুরে ভস্ম হল। একদিন ভগবতী আদ্যাশক্তি সেই অরণ্যে এসেছেন। দেখলেন অসুরের তপস্যায় সমস্ত অরণ্য পুড়ে ভস্ম। দেখলেন একটি সিংহ পুরে দগ্ধ হয়ে মারা গেছে। বাহন জাতির এই অবস্থা দেখে দেবী প্রথমে খুবুই শোকাতুরা হলেন। পরে বললেন — “যার কারণে তোমার এই অবস্থা হয়েছে তাহাকে আমি তোমার রূপেই বধ করবো।” এই বলে দেবী নারসিংহী রূপ ধরলেন — যার অর্ধেক নর অর্ধেক সিংহ। দেবী দেখলেন রুরু তপস্যা করছে, তারই তপাগ্নিতে চারপাশ দগ্ধ হচ্ছে। দেবী বললেন — “ওরে পামর ! তোর তপস্যার পেছনে নিশ্চয়ই কু অভিসন্ধি আছে। শীঘ্র এই তপস্যা বন্ধ কর। কারণ তোর ন্যায় অসুর শক্তিলাভ করলে ত্রিলোক ধ্বংস হবে।” রুরু তপস্যা ছেড়ে দেবীকে আক্রমণ করল। দেবী নারসিংহীর সাথে অসুরের যুদ্ধ আরম্ভ হল। দেখতে দেখতে অসুর পরাজিত হয়ে দেবীর হস্তে নিধন হল।
রুরু অসুরের পুত্র দুর্গম ছিলেন মহা পরাক্রান্ত এবং মহাতপস্বী। রুরুর পুত্র দুর্গম অসুর পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে বলে স্থির করলো। দুর্গম দেখলো বেদ হল মন্ত্রের আধার, ঋষিরা বৈদিক মন্ত্রে দেবতাদিগকে হব্য প্রদান করে। এতে দেবতারা শক্তিশালী হয়ে ধরিত্রী কে সুজলা সুফলা রাখে। তাই বেদাধিকার করতে হবে। দুর্গম অসুর বেদ প্রাপ্তির জন্য ব্রহ্মার কঠোর তপস্যা আরম্ভ করলো। দুর্গম বেদ করায়ত্ত করার জন্য হিমাচলে তপস্যা শুরু করেন। উদ্দেশ্য একটাই, দেবকুল ধ্বংস করা। দুর্গমের মহা তপস্যা হাজার বছর অতিক্রান্ত হলে মহাতেজে জগৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠল। অবশেষে ব্রহ্মা তাঁকে দেখা দিলেন এবং বর দানে সম্মত হলেন।
প্রজাপতি ব্রহ্মা বর দিতে আসলে দুর্গম চতুর্বেদ প্রার্থনা করলেন এবং সেই সঙ্গে ব্রহ্মার কাছে বর চেয়ে নিলেন যে তাকে একমাত্র এমন এক নারী বধ করবে যে অনাবদ্ধকে আবদ্ধ করে। ব্রহ্মা তথাস্তু বলে প্রস্থান করলেন। ব্রহ্মা চতুর্বেদ প্রদান করলে দুর্গম বেদ গুলো নিয়ে পাতালে বন্দী করলো। এর ফল হল ভয়ানক। মুনি ঋষিরা সমস্ত বৈদিক মন্ত্র আচার অনুষ্ঠান বিস্মৃত হলেন। যাগ যজ্ঞ পূজো পাঠ চুলোয় উঠলো। দেবতারা হব্য না পেয়ে দুর্বল হলেন। দুর্গম অসুর এই সুযোগে অমরাবতী আক্রমণ করলেন এবং জয় করে স্বর্গ দখল করে দেবতাদের বিতারিত করলেন। দেবতারা স্বর্গচ্যুত হয়ে পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। মর্তে নেমে এলো আকাল দুর্ভিক্ষ। ফসল বৃষ্টির অভাবে হল না। নদী নালা সব শুকিয়ে গেলো। গাছপালা শুকিয়ে মরুভূমির সৃষ্টি হল। মানুষ পশু পাখী না খেতে পেয়ে সমানে মারা গেলো।
মুনি ঋষি ও সাধুজনেরা হিমালয়ে গিয়ে ভগবতী মহামায়ার স্তবস্তুতি করলেন। ভগবতী মহামায়া তখন শতাক্ষী রূপে আবির্ভূতা হলেন। যাঁর দেহে শত নয়ন। মর্তের লোকেদের এত কষ্ট হাহাকার দেখে জগত জননীর খুবই কষ্ট হল। সন্তান দের কষ্ট দেখে মা যেমন কাঁদে তেমনি শতাক্ষী দেবী রোদন করতে লাগলেন। দেবীর চোখের জলে পুনঃ নদী, নালা, খাল, বিল জলে পূর্ণ হয়ে জলাভাব দূর হল। কিন্তু খালি জল খেয়ে ত পেট ভরে না- আহার চাই। শতাক্ষী দেবী তখন শাকম্ভরী রূপ ধরলেন। হস্তে ধারণ করলেন ফল- মূল- কন্দ- শাক- পাতা। মর্ত লোকে প্রদান করলেন দেবী। তিনি যে অন্নপূর্ণা। মানুষ ও পশু পক্ষীরা তাহা আহার করে উদরের ক্ষুধা নিবৃত্ত করলো। এবার অসুর বধের পালা। দেবী শাকম্ভরী তখন অষ্টাদশভুজা উগ্রা দেবীমূর্তি ধারণ করে রথে আসীনা হয়ে দুর্গম কে যুদ্ধে আহ্বান করলেন।
অসুররাজ দুর্গম দেবীকে দেখে অট্টহাস্য করতে লাগলো। দেবী বললেন — “ওরে দুরাচারী। যদি বাঁচতে চাস তবে এই মুহূর্তে স্বর্গরাজ্য ছেড়ে , চতুর্বেদ কে মুক্ত করে পাতালে চলে যা — নচেৎ তোর ধ্বংস করবো।” দুর্গম অসুর ত শুনলোই না। হাস্য করে বলল — “দেবতারা শেষে এক নারীকে যুদ্ধে পাঠিয়েছে ? কোথায় সেই ভীত দেবতাগণ ? এই তাহাদের বীরত্ব। আরে গর্বিতা নারী- আমার পরাক্রমের সামনে তুই কি ?” এই বলে দুর্গম অসুর সেনা নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
দেবীর শরীর থেকে ৩২ জন্য মহাবিদ্যা প্রকট হলেন। ৩২ দেবী যুদ্ধে অগ্রসর হলেন। এই ৩২ দেবীর নাম দেবীভাগবত পুরাণে আছে। এঁনারা সকলেই আদিশক্তির রূপ। ৩২ দেবী এমন ভয়ানক যুদ্ধ আরম্ভ করলেন যে অসুরেরা কাতারে কাতারে বিনষ্ট হতে লাগলো। চারপাশে কেবল অসুর দের দেহ আর রক্ত মাংসে আচ্ছাদিত হল। প্রলয়ঙ্করী সেই বত্রিশ দেবীর হাতে দুর্গমের সকল বলশালী সেনাপতি, মন্ত্রী সকলে নিহত হল। বিন্ধ্যাচলে টানা দশদিন ধরে এই মহাযুদ্ধ চলল। যুদ্ধে দেবী দুর্গম অসুরের অসংখ্য সৈন্যকে হত্যা করেন। ক্রমশ অসুরেরা সংখ্যায় কমে গেলো।
দুর্গম অসুর তখন সেই অষ্টাদশভুজা দেবীর সাথে যুদ্ধ আরম্ভ করলেন। অসুর নানা অস্ত্র এমনকি পর্বতের চূড়া দেবীর পানে ছুড়লো। দেবী স্বীয় অস্ত্রে সে সকল ধ্বংস করলেন। অন্তিমে দেবী শর দ্বারা দুর্গম অসুরের বুকবিদ্ধ করে দিলেন। দেবীর শরে দুর্গমের প্রান গেলো। দুর্গম অসুরের মধ্য থেকে এক জ্যোতি প্রকট হয়ে দেবীর মধ্যে বিলীন হয়ে গেলো। চার বেদ মুক্ত হল। ত্রিলোকে শান্তি নেমে এলো। দেবতারা স্বর্গ ফিরে পেলেন। তখন দেবী বললেন — “দুর্গম অসুর বধ করে আজ থেকে জগতে আমি ‘দুর্গা’ নামে খ্যাতা হবো।”
বর্তমানে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়া আদ্যাশক্তির দেবী দুর্গার আরাধনা হয়ে আসছে সেই সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকেই। পুরাণে বর্ণিত কাহিনী অনুযায়ী, শুধুমাত্র সাধারণ মানুষ নয় দেব-দেবীরাও দেবী দুর্গার আরাধনা করেছেন। তবে সব থেকে বেশি জনপ্রিয় হল রামের অকালবোধন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী, প্রথম দুর্গা পুজো করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণ সৃষ্টির প্রথম যুগে বৈকুন্ঠের আদি বৃন্দাবনের মহারাসমণ্ডলে সর্বপ্রথম দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন।
‘দুর্গা’ শব্দটি ভাঙলে বেশ কতগুলি অক্ষর পাওয়া যায়। হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে, দুর্গা নামের ‘দ’ অক্ষরের অর্থ দৈত্যনাশক। ‘দ’ এর সঙ্গে থাকা ‘উ’ কারের অর্থ বিঘ্ননাশক। দুর্গা নামের ‘রেফ’ এর অর্থ রোগনাশক। পাপ বিনাশ করা বোঝায় দুর্গা নামের ‘গ’ অক্ষরে। অপরদিকে ভয় এবং শত্রু নাশকের প্রতীক হল দুর্গা নামের ‘আ’ কার। এই হল দেবী দুর্গার নামের আসল অর্থ।