মলয় দে নদীয়া:-উৎসবের শহর নদীয়ার শান্তিপুরে বারো মাসে তেরো পার্বণ এর মাঝে দোল বা হোলি উৎসবের এক বিশেষ আবেগ শান্তিপুর শহর কে সম্পৃক্ত করেছে । বিভিন্ন আকৃতির বা নামের গোপালের ভোগ রাগ বা আড়ম্বরের মাঝে বিগ্রহের বিবাহ বন্ধনের একটি একটি গল্প বা ইতিহাস শান্তিপুরের দোল উৎসবকে আরো মাধুর্যতা দান করেছে । তাহলো রাধারানী এবং শ্রীকৃষ্ণের বিবাহ বার্ষিকী। রীতিমতো শোভাযাত্রাসহ বরযাত্রীর আগমন, আপ্যায়ন, কব্জি ডুবিয়ে প্রীতিভোজ। ভাবছেন তাও আবার সম্ভব নাকি? চলুন দেখে নেওয়া যাক সেই সব চিত্র, শুনে নেওয়া যাক এই সংক্রান্ত নানান ঐতিহ্য পরম্পরার কাহিনী।
ইতিহাসের তথ্য বলছে ১৭২৬ সালে শ্যাম চাঁদ প্রতিষ্ঠা করেন খাঁ চৌধুরী পরিবার । এই সময় উড়িষ্যা র পুরি থেকে রাধা বল্লভ গোস্বামী একটি গোপাল আনেন । এই সময় তাকে ৫০ বিঘা জমি সহ উড়িয়া গোস্বামী পরিবারের মদন মোহন বিগ্রহ প্রদান করা হয় শ্যাম চাঁদ বিগ্রহের প্রতিষ্ঠাতা খাঁ চৌধুরী পরিবার কর্তৃক । আবার চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী শ্যাম চাঁদের দোল অনুষ্ঠিত হয় প্রতিপদ তিথিতে অর্থাৎ সাধারণ ভাবে দোল উৎসবের দ্বিতীয় দিনে ,আর ঠিক সেই কারনেই উড়িয়া গোস্বামী পরিবার শ্যাম চাঁদের নিয়ম মেনে একইদিনে দোল উৎসব পালন করেন ।
তথ্য বিশ্লেষণ করলে আরো জানা যায় আজ থেকে প্রায় ৮০ বছর আগে মদন মোহনের রাধিকা চুরি হয়ে যায় । অপর দিকে আতা বুনিয়া গোস্বামী লেনের মুখার্জী পরিবার থেকে চুরি হয়ে যায় কৃষ্ণ । ঠিক এমত পরিস্থিতিতে উড়িয়া গোস্বামী পরিবার থেকে আতা বুনিয়া লেনে বাসিন্দা মুখার্জি পরিবারের নিকট থেকে রাধিকা টি চাওয়া হয় তাদের মদন মোহন বিগ্রহের জন্য বা তাদের বিগ্রহের শোভা বর্ধনের জন্য । উক্ত পরিস্থিতেতে এভাবে তাদের পরিবারের রাধারানী হাত ছাড়া করতে চান না মুখার্জি পরিবারের কর্মকর্তারা । তারা দাবি জানান তাদের তাদের পরিবারের রাধারাণীর বিবাহ দিতে হবে উড়িয়া গোস্বামী পরিবারের মদন মোহন বিগ্রহের সাথে । অর্থাৎ ঠিক সেই সময়ে মদন মোহন বিগ্রহের সাথে মুখার্জি পরিবারের রাধারাণীর বিবাহ সংগঠিত হয় , এইভাবে উড়িয়া গোস্বামী বাড়ীর বিগ্রহ মদনমোহন হয়ে ওঠেন আতা বুনিয়া গোস্বামী লেনে র বাসিন্দা মুখার্জি পরিবারের জামাই । এবং এই সময়ে দুই পরিবারের মধ্যে শর্ত হয় বছরে একটা দিন মেয়ে জামাই আসবেন মুখার্জি পরিবারে । আর সেই দিনটি হলো দোল পূর্ণিমার দিন , এদিন প্রত্যেক বছর চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী উড়িয়া গোস্বামী পরিবারের বিগ্রহ আতা বুনিয়া গোস্বামী পরিবারে আসেন বেড়াতে বাজনা বাজিয়ে এবং আলোক সজ্জা নিয়ে । বাড়ীর মেয়ে জামাই বাড়িতে এসেছে বলে তাদের সাদরে বরণ করেন মুখার্জি পরিবারের পক্ষ থেকে । যথেষ্ঠ ভক্তিভরে বিগ্রহ কে পূজা অর্চনা করা হয় ,তাছাড়া বিগ্রহের সাথে যারা মুখার্জি পরিবারে আসেন তাদেরকে বর যাত্রী হিসাবে সাদরে সম্ভাষণ জানিয়ে ঠাকুরের প্রসাদ খাওয়ানোর ব্যাবস্থা করা হয় মুখার্জী পরিবারের পক্ষ থেকে । তবে অতীতে আরো আড়ম্বর হতো বর্তমান পরিস্থিতিতে এইসকল আড়ম্বর অনকেটাই সংকুচিত হয়ে গেছে বলে স্থানীয়রা জানাচ্ছেন ।
এদিন সমস্ত বর যাত্রীকে খাওয়ানো হলো লুচি , ছোলার ডাল এবং আলুর দম । এইসকল খাদ্য খাবার প্রসাদ হিসাবে বিতরন করা হলো উপস্থিত সমস্ত বরযাত্রীদের এবং এলাকাবাসীদের । এই বাড়ীতে উপস্থিত বিগ্রহ কে কাছে পেয়ে প্রত্যেকেই যথেষ্ঠ ভক্তিভরে বিগ্রহের চরণে আবিরে ভরিয়ে দিয়ে প্রণাম ও প্রার্থনা জানালেন ।
এরপরে বিগ্রহ সরাসরি রওনা দিলেন তার নিজের বাড়ি অর্থাৎ উড়িয়া গোস্বামী বাড়ীর দিকে , সেখানেও মদন মোহন বিগ্রহকে সামনে রেখে অনুষ্ঠিত হলো নেরা পোড়া পুজো , আরতি এবং এরপর নেরাপোড়ার বিচুলিতে অগ্নির সংস্পর্শ দেওয়া হলো পুরোহিত কর্তৃক । এরপরেই বিগ্রহ মদন মোহন রাধারানী সহ রওনা দিলেন তার নিজের গৃহের উদ্দেশ্যে । অর্থাৎ একটি উৎসবের মধ্যে আরেকটি উৎসব , যেন সাহিত্য সৃষ্টির মত একটি ঘরের ভিতর আরো একটি ঘর।
সাহিত্যিক দের ন্যায় একটি ছোটো গল্পের মধ্যে আরো একটি গল্প যতটা ছোট গল্পকে সার্থক করে তোলে ঠিক তেমন ভাবেই বসন্তের দোল উৎসবে একটি বিবাহের গল্প এবং বর্তমান ডিজিট্যাল দুনিয়ার প্রেক্ষাপটেও শান্তিপুরের দোল উৎসবের মাধুর্য ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার আগামী প্রজন্মের কাছে সংরক্ষিত করার উদ্দেশ্যেই আমাদের এই প্রতিবেদন ।