নস্টালজিয়া

Social

বিকাশ চক্রবর্তী : ছেলেবেলার কথা মনে আসলেই, স্মৃতি থেকে উঁকি দেয় পুরোনোর সিনেমার রিলের স্তূপ। তার কোনোটাতে রয়েছে ভালোলাগার কোনো দৃশ্য, আবার, কোনোটাতে মনখারাপের সাদাকালো ছবি।

ছোট শহরে বেড়ে উঠা। ছিল না প্রকৃতির নিবিড় আলিঙ্গন, আবার শহরের কোলাহলও ছিল না।

তবে চোখ বুজলেই ভরদুপুরের নির্জন রাস্তা অথবা শীতের বিকেলে ঝুপ করে নেমে আসা অন্ধকার মাখা মাঠের কথা এখনো মনে পড়ে।

ছোটবেলায় অদ্ভুত সব খাবার খেতাম। কত ধরনের যে লজেন্স খেয়েছি। এখনো মনে আছে, হাওয়াই মিঠাইয়ের কথা, মনে আছে বরফ আর রঙ মিশিয়ে আইসক্রীম গোলার কথা।

মাঝে মাঝে যখন গ্রামে দাদুর বাড়ি বেড়াতে যেতাম, কাঞ্চনগাছের পাতা দিয়ে বাঁশী বানিয়ে বাজাতাম। সুপারি গাছের পাতার গোড়াতে একজন বসত, আর একজন পাতার আগা ধরে টেনে নিয়ে যেত।

প্রতিবছর নিয়ম করে, দোলের আগের দিন নেড়াপোড়া করা হত! সকালে ঘুম থেকে উঠে গাছের ডালপালা, বাঁশ দিয়ে নেড়া ও নেড়ির বাড়ি বানাতাম। তারপর সারা পাড়া পরিস্কার করে গাছের শুকনো পাতা, ডালপালা এনে নেড়া-নেড়ির ঘর ভর্তি করে দিতাম। মাটির হাড়িতে চক দিয়ে চোখ মুখ এঁকে নেড়া ও নেড়ি বানিয়ে, শুকনো পাতা ভর্তি ঘরে তাদের রেখে দেওয়া হতো। সন্ধ্যে বেলায়, আকাশে
যখন গোল চাঁদ উঠত, তখন আমরা নেড়া-নেড়ির ঘরে আগুন লাগিয়ে দিতাম। আগুনের মধ্যে ছুড়ে দিতাম আলু। আগুনের শিখা তখন, একতলা ছাদ ছাড়িয়ে গেছে, আমরা সবাই মিলে, গাইতাম
আজ আমাদের নেড়াপোড়া,
কাল আমাদের দোল,
পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে,
বল হরিবোল!!

পুরোটা ঠিকঠাক মনে নেই। আগুন নিভে এলে, পোড়া আলু খুঁজে বের করে, নুন দিয়ে খাওয়া হতো। শৈশবের সেই পোড়া আলুর স্বাদ ছিল অমৃত।

ছোটোবেলায় বাড়িতে টিভি ছিল না। পাশের বাড়িতে টিভি দেখতাম। এখনো মনে আছে, “দামু” সিনেমার কথা। মনে আছে, সাদাকালো ঢাউস বোকাবাক্সে “চারমূর্তি” সিনেমার টেনিদার বিখ্যাত সেই খাওয়ার দৃশ্য।

সেই সময় “ভিডিও” দেখার চল ছিল। কোনো অনুষ্ঠান হলেই, সবাই মিলে টাকা দিয়ে ভিডিও ভাড়া করে আনা হত। বিশাল বড় বড় ক্যাসেট চালিয়ে সন্ধ্যের আসর জমে উঠত। সারারাত ধরে চলত ভিডিও । একরাতে ৪ টে সিনেমা । সরস্বতী পূজা ও শিবরাত্রিতে ভিডিও ভাড়া বেশি ছিল ।

ছেলেবেলায় “ঝুলন” করতাম। রাখীপূর্ণিমার আগে হতো। কাঠের গুঁড়ো রঙ করে, রাস্তা, মাঠ তৈরী করতাম। মাটি গোলা জলে কাপড় চুবিয়ে পাহাড় বানাতাম। স্টীলের থালাতে জল দিয়ে পুকুর হতো। শেষের দিন মা খিচুরি রান্না করে দিত।

একবার মনে আছে, গরমকালে জলছত্র বসিয়েছিলাম। তখন গরমের ছুটিতে আমরা পড়াশুনো করতাম না। একটা মাটির কলসীতে জল আর বাতাসা নিয়ে বসে যেতাম। সাথে একটা “লোকনাথ বাবা”র ফটো থাকত। লোকজন জল বাতাসা খেয়ে টাকা দিয়ে যেত। প্রায় একমাস জলছত্র করার পর অনেকগুলো টাকা জমেছিল। সেই টাকাতে খিচুরি হয়েছিল।

কালীপুজোর সময় আমরা ছোটরা করতাম হনুমান পুজো। রীতিমতো চাঁদা তুলে।

অদ্ভুত সব খেলা খেলতাম খুব ছোটবেলায়। ছেলে মেয়েরা একসাথেই খেলতাম। পিট্টু, ডাংগুলি, লুকোচুরি, সিঁদুর টোকাটুকি, বুড়ি ছোঁয়া, চোর পুলিশ।
একটু বড় হলে ক্রিকেট, আমরা বলতাম, ব্যাট-বল খেলব, চল্!

তারপর একসময় গোঁফের রেখা গজাল, নাইনে উঠলাম। কুনোব্যাঙের শরীরতন্ত্র পড়বার সময় গলার জোর কোথায় যেন হারিয়ে যেত, ফিসফিস করে পড়তাম! বড় হতে শুরু করলাম।

একবার এক বন্ধুর ছাদে গিয়ে সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করলাম। সেবার ভয় ছিল, যদি বাড়িতে জেনে যায়!

নাইন থেকে টেনে উঠলাম। ছেলেবেলা কেমন যেন হঠাৎ করে বিদায় নিল। দুপুর- বিকেলে খেলতে যাবার বদলে রায়-মার্টিন, টেষ্ট পেপার থেকে অঙ্ক কষতাম।

ছোটোবেলাতে আরেকটা ভালো নেশা ধরেছিল। বই পড়ার নেশা। গোগ্রাসে গিলতাম। আমার বই পড়ার সাথী ছিল আমার ভাই। একসাথে চাঁদের পাহাড়, আরণ্যক, পথের পাঁচালী পড়েছি। পুজোসংখ্যা শুকতারা, আনন্দমেলাও একসাথে পড়তাম!

প্রতিমাসে শুকতারা, আনন্দমেলা নেওয়া হত। দু-চারদিনের মধ্যে পুরোটাই পড়ে ফেলতাম। শুকতারাতে তখন পাঠকের চিঠি ছাপা হত। চিঠির নীচে থাকত ঠিকানা। সেই ঠিকানাতে চিঠি পাঠাতাম। এমন করেই অনেক Pen-Friends হয়েছিল।

এমনি করেই একদিন মাধ্যমিক দিয়ে দিলাম। বাড়ি থেকে কখনো বলেনি science নেব, নাকি Arts!! নিজে থেকেই science নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আসলে তখন বড় হয়ে গেছি।