নিউজ সোশ্যাল বার্তা, সঞ্চিতা মন্ডল: হূর্গাদাতে আমাদের প্রথম সকাল। ঘুম থেকে উঠলাম ৭টা নাগাদ। ওঠার তেমন তাড়া ছিল না। ম্যানেজার আগেই বলে দিয়েছিল এখানে লেজার টাইম ফ্রেশ হয়ে গেলাম ব্রেকফাস্ট করতে। ডাইনিং এরিয়া এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত বিরাট বড়। সব কিছু খেয়ে গেলাম লোহিত সাগর ধরে বীচ এর ধারে। ছোটো ছোটো ঢেউ এ পা ভিজিয়ে নিলাম। অন্যান্য দেশের লোকেরা বাচ্চা বুড়ো বয়স্ক রা দেখছি সমুদ্রে খুব আনন্দ করছে। আমাদের দেশের ছোট বাচ্চাদের কে নিয়ে যে ভাবে মা-বাবারা সব কিছুতে আদিখ্যেতা করে সেটা বিদেশীদের মধ্যে নেই। বছর দুই এক এর বাচ্চাদেরকে তার মা বাবা সমুদ্রে ছেড়ে দিয়েছে। দিব্যি বাচ্চা গুলো উপভোগ করছে। এক দম্পতি দেখলাম আঠ মাসের বাচ্চাকে নিয়ে সমুদ্রে নেমছে। কোনো ব্যাপারই না ।
যাক এই সব দেখে তোয়ালে কার্ড দেখিয়ে তোয়ালে নিয়ে গেলাম হোটেলের লবিতে ১০.৩০ টা নাগাদ টুর ম্যানেজার এর কথামত। এখন যাবো লোহিত সাগর এ কোরাল দেখতে আর স্নোরকেলিং করতে। এর জন্য টুর ম্যানেজার সবার কাছ থেকে ৪০ ডলার করে নিয়েছে। বাসে করে পৌঁছালাম বোট এর কাছে।বোটে উঠলাম।আসলে বোট নয়। ওটা হচ্ছে অর্ধেক সাবমেরিন। বোট ছাড়লো। অপুর্ব পান্না সবুজ জলরাশি ছেড়ে যাচ্ছি নীল জলরাশির দিকে। এর মধ্যে বোট এ আমাদেরকে পেপসি খেতে দিলো।সুন্দর মুহূর্ত গুলো ক্যামেরাবন্দি করলাম। দু চোখ ভরে লোহিত সাগর কে উপভোগ করতে লাগলাম। আর মনে মনে ভাবলাম এই পৃথিবীতে কত সুন্দর সুন্দর মন ভোলানো জায়গা আছে। অনেকের দেখার ইচ্ছে থাকলেও দেখতে পারে না অর্থের জন্য। জীবনটাকে ভালো ভাবে উপভোগ করতে গেলে পৃথিবীর সব কিছু জিনিস হাতের মুঠোয় আনতে চাইলে অর্থ ই তো সব । অর্থই জীবনে সব। যাক এইসব ভাবছি যখন এক মনে তখন বোট এর গাইড আর আমাদের গাইড বললো বোটের তলাতে যেতে। আমরা সিড়ি দিয়ে গেলাম নিচে। বসার জায়গা আছে। কাঁচের ভেতর থেকে অপূর্ব দৃশ্য দেখলাম লোহিত সাগর এর তল দেশ। কত রকমের কোরাল কত রকমের মাছ। এ তো যেন বিশ্বাস ই হতে চাইছে না। সমুদ্রের তলায় এত সুন্দর জগৎ আছে। আহারে মানুষ এর দ্বারা দূষণ এ এদের জীবনকে আমরা বিপন্ন করে তুলছি। প্রচুর ছবি তুললাম। এর মধ্যে বোট এর গাইড কে দেখলাম জলের তলায়। মাছ দেরকে খাবার দিচ্ছে আর মাছ গুলো বোট এর ধারে ধারে ঘুরছে। বোট এর ছেলেটি জলের তলায় কত রকম কিছু করে দেখালো গিটার বাজানো ডান্স করা। আমরা খুব মজা নিতে লাগলাম। এইভাবে ২০ মিনিট কাটানোর পর বোট এর উপরে উঠে এলাম। ড্রেস চেঞ্জ করে সাঁতার এর উপযোগী ড্রেস পরে নিলাম। মুখে চোখে মাস্ক লাইফ জ্যাকেট পরে নিলাম। বোট এর সিড়ি দিয়ে নামলাম জলে snorkeling করতে। বডি টা ভাসবে আর মাথাটা নামিয়ে সমুদ্রের নিচের ওই কোরাল দেখা মুখ নামিয়ে। মিনিট ১৫ পর উঠে এলাম বোটে । বোটের বাথরুমে ড্রেস চেঞ্জ করে এসে যখন বসলাম বোট তখন তীরের কাছাকাছি । বোট থেকে নেমে বিদায় জানিয়ে বাসে উঠলাম। মিনিট ২০ পর হোটেল পৌঁছে সোজা লাঞ্চ এ।
লাঞ্চ সেরে আর রুমে না ফিরে আবার হোটেল এর বীচ এ গেলাম। সেখানে আমরা কজন মিলে প্রায় ঘন্টা আড়াই সমুদ্রে লাফালাফি জল কেলি করে গেলাম হোটেলের সুইমিং পুলে। সেইখানে আধ ঘন্টা পর সুইং মিং পুল থেকে তুলে দিলো। কেননা বিকেল ৫ টার পর আর পুলে নামতে দেবে না। কিছু স্ন্যাকস খেয়ে গেলাম রুমে ফ্রেশ হতে। রুমে ফ্রেশ হয়ে আবার ৭ টা নাগাদ এলাম পুল এলাকাতে । রাতের অন্ধকারে হোটেল টিকে আরো মনো-মুগ্ধকর লাগছে।অনেকেই দেখছি প্রচুর ড্রিংক খাচ্ছে। কেও হার্ড ড্রিংক কেও সফট ড্রিংক কেও চা কফি ককটেল মকটেল খাচ্ছে যথেচ্ছ। এরপর এলো রাতের খাবারের সময়। রাতের খাবার খেয়ে ওই হোটেলের গ্যালারি তে গেলাম ডান্স শো দেখতে। আধ ঘন্টা দেখে চলে এলাম। রাস্তাতে দেখা আমাদের টুর ম্যানেজার আর টুর গাইড এর সঙ্গে। টুর গাইড হেসে বলে উঠলো আপনারা খুব লাকি আপনাদের কথা ভগবান শুনেছে । আমরা বললাম মানে? টুর ম্যানেজার বলে উঠলো হ্যারিকেন ঝড় দেখা দিয়েছে ইজিপ্ট এর সরকার সব রাস্তা ব্লক করে দিয়েছে। তার জন্য আমাদের কালকে ৬ টা তে বেরোনো হবে না। কখন বেরোব জানি না। ধরে রাখো কাইরো মিউজিয়াম দেখানো হবে না। মন শুনে খুব খারাপ হয়ে গেলো। ওদের কথা বিশ্বাস করতে না পেরে গেলাম হোটেল এর রিসেপশন এ। জিজ্ঞাসা করতে বললো হ্যা আপনাদের টুর ম্যানেজার তাই বললো আমার কাছে কিছু খবর নেই। মন খারাপ নিয়ে শুয়ে পরলাম সেই রাত্রে।
পরদিন সকাল সকাল অ্যালার্ম বাজার আগেই ঘুম ভেঙে গেলো। ঘড়িতে তখন ৬ টা। উঠে স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে একদম তৈরি হয়ে লাগেজ রেডী করে !ব্রেকফাস্ট করার জন্য গেলাম। ব্রেকফাস্ট করে টুর গাইড এর সঙ্গে কথা বললাম। বললো কখন বেরোনো হবে জানি না। টুর ম্যানেজার এর চোখে মুখে তেমন চিন্তার কোনো ছাপ দেখতে পেলাম না যদিও। এই দিকে হোটেল এ ১১ টা বেজে গেলে আর থাকতে দেবে না। যেই ১০.৩০ টা বাজলো কি একটা ফোন এলো টুর ম্যানেজার এর কাছে। অমনি টুর ম্যানেজার বললো ১৫ মিনিট এর মধ্যে লাগেজ নিয়ে লবিতে হাজির হন। যে যার নিজের রুমের চাবি তোয়ালে কার্ড সমেত জমা করুন। আমরা সেইসব জমা করে এত সুন্দর লোহিত সাগর এর তীরে হোটেল কে বিদায় জানিয়ে বাসে উঠলাম। বাস ছাড়ল। হারাধন এর ছেলেদের টুর ম্যানেজার গুনে নিল। এইবার টুর ম্যানেজার বকতে শুরু করলো কোনোভাবেই cairo মিউজিয়াম দেখানো যাবে না। পৌঁছাতে ৫ ঘন্টা সময় লাগবে এই সেই। এটাতে তো আমার দোষ নেই ন্যাচারাল ক্যালামিটি । আমরা বললাম লাঞ্চ করবো না। সেই জায়গাতে হোক। আমাদের কিছু দরকার নেই শুধু মমি রুম দেখব। তাতেও কোনো ভাবেই টুর ম্যানেজার কে গলানো গেলো না। বললো বিকেল ৪ টের পর এন্ট্রি পাওয়া যায় না এই সেই। তারপর গাইড বলে উঠলো রাস্তা এর পাশে দেখুন সুয়েজ ক্যানাল। এরপর বাস এসে পৌঁছল লাঞ্চ এর জন্য একটা হোটেল এ । লাঞ্চ করলাম ওই একই ধরনের। স্টিকি রাইস গ্রিলড চিকেন , রুটি ওই ফ্রাই সব্জি। ওখানে এক ঘণ্টা গেলো। তারপর বাস এ উঠলাম । এখন অব্দি গোটা রাস্তাতে কোথাও ঝড় এর বিন্দুমাত্র কিছু দেখতে পেলাম না। সাহারা মরুভূমির পাশ দিয়ে যাচ্ছি ধূ ধূ বালি নেই আছে পাহাড় । এর মধ্যে সাহারার বুকে শেষ বারের মত অস্ত যেতে যাওয়া সূর্য কে দেখে নিলাম। অতঃপর ৫ টা নাগাদ আবার এসে পৌঁছলাম cairo তে। আরো এক ঘন্টা ট্রাফিক কাটিয়ে পৌঁছালাম খান আল খালিলি বাজারে কিছু কেনা কাটা করতে। আগেই শুনেছিলাম এই বাজারে দাম দর করে কিনতে হয়। দাম দর করা বাজার যেখানেই আছে বাঙালিরা সেইখানে পৌঁছাবে না সেটা হতেই পারে না। এক একটা দোকানে ঢুকলাম পিরামিড এর দাম জিজ্ঞাসা করতে দাম যা বললো সেটা শুনে বেরিয়ে এলাম দোকান থেকে ভাবলাম আমাদেরকে আবার ডাকবে। কিন্তু কোনো দোকান ডাকছে না সেই দোকান থেকে বেরিয়ে গেলে। আমাদের এইখানে যেমন হয় আর কি। কিন্তু এইখানে সেটা নয় । পিরামিড শোপিস কিনে আরো কিছু শোপিস কিনে হাজির হলাম মিটিং পয়েন্টে।সেইখানে থেকে বাসে উঠে বসলাম । বাসে আবার টুর ম্যানেজারকে বললাম যে দেখুন না কালকে যদি একবার মমি রুম টা দেখানো যায়। আধা ঘন্টা দেখে বেরিয়ে চলে আসবো। দরকার পড়লে আমরা কেও ব্রেকফাস্ট করবো না। টুর ম্যানেজার কোনো ভাবেই আমাদের কথা শুনতে বা মানতে রাজি নয়। টুর ম্যানেজার বলে উঠলো তার থেকে বরং আপনাদেরকে মিউজিয়াম দেখার ১৮ ডলার করে ফেরত দিয়ে দেওয়া হবে অফিস থেকে কলকাতাতে গিয়ে নিয়ে নেবেন ।আমরা বললাম ১৮ ডলার ফেরত দিলে কি আমরা আবার মিউজিয়ামটা দেখে যেতে পারবো ওই টাকাতে?! টুর ম্যানেজার বললো কিছু করার নেই। টুর ম্যানেজার নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। এই করতে করতে আবার সেই আগের হোটেল এ এলাম। Pyramid’s Park Resort e.. আজকের রাত আমাদের ইজিপ্ট এ কাটানো শেষ রাত। টুর ম্যানেজার সবাইকে পাথর এর তৈরি পিরামিড এর সেট দিল। হাত মিলিয়ে টুর গাইড কে বিদায় জানালাম রাগে। টুর ম্যানেজার এর কাছে রুমের চাবি নিয়ে গেলাম রুমে। লাগেজ পৌঁছে দিয়ে গেছে আগেই। মন কিন্তু খুব খারাপ একটা কথা ভেবেই যে মমির দেশ এ এলাম কিন্তু মমি দেখতে পেলাম না। গেলাম ডিনার করতে। মন খারাপ নিয়ে ডিনার করে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পরলাম।
পরের দিন মন খারাপ নিয়ে ঘুম থেকে উঠলাম ফ্রেশ হয়ে স্নান সেরে তৈরি হয়ে লাগেজ প্যাক করে রুমের বাইরে বের করে দিয়ে ইজিপ্ট এ শেষ বারের মত ব্রেকফাস্ট করার জন্য গেলাম।ব্রেকফাস্ট সেরে এক রাশ মনে দুঃখ নিয়ে বসে উঠে বসলাম ৮ টা নাগাদ। সোজা cairo airport।। কোনো ভাবেই আমাদের আর মিউজিয়াম দেখা হলো না। শেষ বারের মত cairo তে নীল নদ কে দেখে নিলাম । বাস এসে পৌঁছল airport এ। চেকিং করে ইমিগ্রেশন করে ফ্লাইট এর গেট এর কাছে হাজির হলাম।দুপুর ১২ টা তে আমাদের ফ্লাইট cairo থেকে উড়ে গেলো kuwait এর দিকে। আড়াই ঘণ্টা পর kuwait এ এসে পৌঁছল আমাদের ফ্লাইট। এর পর kuwait এ আমাদের আড়াই ঘণ্টার লে অভার ছিলো। লে ওভার কাটিয়ে kuwait airport এর ভেতরে বাসে করে গিয়ে আমরা মুম্বাই এর জন্য ফ্লাইট এ উঠলাম। আড়াই ঘণ্টা ফ্লাইট জার্নি করার পর রাত ১২.১৫ নাগাদ মুম্বাই তে এসে পৌঁছলাম। নিজের দেশ অনুভূতি একটা অন্যরকম। ইমিগ্রেশন সেরে নিজের দেশে ঢুকে পড়লাম অফিসিয়ালি। লাগেজ নিয়ে এইবার অপেক্ষা করতে লাগলাম কলকাতার ফ্লাইট এর জন্য। এক দু ঘণ্টা অপেক্ষা নয় । টানা ১২ ঘন্টা অপেক্ষা করলাম দেশের ভেতর এই যাওয়ার জন্য। ট্রাভেল এজেন্ট এরকম ভাবেই টিকিট বানিয়েছে। এতক্ষন অপেক্ষা করার মানে কি জানা নেই। যদি ধরেই নি ফ্লাইট লেট থাকে। তাই বলে এতক্ষন লেট থাকে। ২৮ তারিখ দুপুর ১২ টার ফ্লাইট ধরলাম মুম্বাই থেকে কলকাতার জন্য। দুপুর ২.৩০ মিনিটে কলকাতাতে নেমে লাগেজ নিয়ে সবাইকে বিদায় জানিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। আর মনে মনে ভাবলাম সব টায় হলো শুধু আসল জিনিস মমি টায় দেখা হলো না। (সমাপ্ত )