মলয় দে, নদীয়া:- “তুঝে…. দেখা.. তো…. ইয়ে ..জানা স্যানাম! পেয়ার… হোতা.. হে …দিবানা সনাম।।”
বর্ধমানের পান্ডুয়া থেকে নদীয়ার শান্তিপুরে আগত মাঝবয়সী অবাঙালি এক হৃষ্টপুষ্ট যুবকের কন্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে গান! শাহরুখ খান ও কাজল নেচে চলেছে তার চারপাশ দিয়ে ঘুরে ঘুরে! ভিড় করে থাকা আবালবৃদ্ধবনিতা হাততালি দিয়ে উৎসাহিত করছেন তাদের! তবে হ্যাঁ ওই দুই লাইনই, এরপরে একই তালে বজরঙ্গি ভাইজান হিন্দি সিনেমার অন্য একটি গান তখন তাদের নাম সালমান করিনা। এভাবেই জমে উঠেছে আসর। না, কোনো পানশালা নয়, বা কোন সিনেমা হলও নয়! একেবারে খোলা আকাশের নিচে পাড়ার মধ্যে ছোট্ট একটি খোলা জায়গায় চলছে আইনি জটিলতায় প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া বাঁদর খেলা। নৈতিকতার প্রশ্ন থাকতেই পারে আপনাদের, ওই বাঁদর খেলা দেখানো যুবককে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়নি কেনো? আমরাও জানতে চেয়েছিলাম পান্ডুয়া থেকে আগত মোহাম্মদ সুখিন কে? সে জানায় মানুষের থেকেও বেশি বছর বাঁচে বাঁদর, আমার বাবা এদেরকে নিয়েই খেলা দেখিয়ে উপার্জন করে বড় করেছে আমায়। এইতো কয়েক বছর আগে সরকার আইন আনলো পশুদের খেলা দেখানো যাবে না। ছোটবেলায় অল্প অল্প মনে পড়ে জঙ্গলে যতবার ছেড়ে দিয়ে এসেছি! ততবার ফিরে এসেছে, ওরাও মানুষের মাঝে থেকে পশুর আদব-কায়দা ভুলে গেছে! রক্তারক্তি হয়ে বাড়ি ফিরে গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদত! আমরাও পরিবারের অন্য ভাইবোনদের মতোই মেনে এসেছি ওদের। মেরে ধরে নয়, তিনবেলা খাওয়ার দেওয়ার আগে যেভাবে শিখিয়েছি সেই ভাবেই ওরা চলে ভালোবেসে। ওরাও বুঝে গেছে, পরিবারের সকল সদস্যদের একটা নির্দিষ্ট কাজ থাকে, তাদের কাজ, বিভিন্ন শারীরিক কসরত, মজা এবং নাঁচ দেখানো।
লকডাউনে বন্ধ হয়ে গেছে, সকলের রোজগার! ওদের দুজন আর আমাদের তিনজন পাঁচজনের ডালরুটি জোগাড়ে মাঝে মাঝে খেলা দেখাতে বেরোলেও আগের মতন তরিতরকারি চাল পয়সা ওঠে না ঠিকমত। তাই আইনের ভয় পাইনা, পেট ভর্তির ব্যবস্থা করলে, জেলে গিয়েও থাকতে রাজি।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হিন্দুস্তানি আধবাংলায় বলে ওঠে! কিরে করিনা সালমান আমায় ছেড়ে যাবি নাকি! ঘাড় নাড়িয়া উত্তর আসে না। এই সাংবাদিক বাবুরা বলছে জেলে ভরে দেবো, কি করবি জেলে গিয়ে, দুহাতে অঙ্গভঙ্গি করে বানরদ্বয় মুখে পেটে হাত দিয়ে বোঝাতে চাইছে খেতে দিলেই রাজি!
বলেই স্বভাবসিদ্ধভাবে হাতের ডুগডুগি বাজিয়ে, বাচ্চালোগ একবার জোরসে হাততালি!
আবার শুরু হয়ে গেলো খেলা, জামাইষষ্ঠীতে বানরদ্বয় কিভাবে যাবে, কিভাবে মাস্ক পড়বে, বিমারি হলে ডাক্তারবাবুরা কিভাবে ইনজেকশন দেবে এ ধরনের নানা মজাদার অঙ্গভঙ্গি। দর্শকদের হাজারো করতালির মাঝে, বিলীন হয়ে গেল নৈতিকতা! পকেট থেকে ৫০ টাকার একটি নোট বের করে, তাদের হাতে দিয়ে ফেরার সময়, শুধু একটা কথাই মনে পড়ছিলো ! প্রগাঢ় ভালোবাসায় বনের পশুও, পোষ মেনেছে তার কাছে, স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে তার পরিবার সদস্য হিসেবে থাকতে! আর আমরা মানুষ হয়ে মানুষকে কতটুকু বুঝতে বা বোঝাতে পারি? পরিবারের অন্য সদস্যদের উপরই, বা কতটুকু নিয়ন্ত্রণ আমাদের?