মলয় দে, নদীয়া :- আজ থেকে প্রায় দশ পনেরো বছর আগে এই জামাই ষষ্ঠীর দিন এবং তার পরের দিন প্রবল ভীড় জমতো বা জনকোলাহলে পূর্ণ হয়ে উঠতো শান্তিপুরের প্রধান দুটি চলচ্চিত্র কেন্দ্রে — শান্তিপুর পাবলিক লাইব্রেরি নিকটস্থ সুশ্রী এবং শান্তিপুর শ্যামবাজার এলাকায় অবস্থিত সুন্দর শ্রী সিনেমা হল দুটিতে । বাংলা এবং হিন্দি যে সিনেমাই চলুক জামাই ষষ্ঠী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পূজা পার্বনেও আট থেকে আশি বিনোদন প্রেমী মানুষের সমাগম ঘটতো এই সিনেমা হল দুটিতে । এমনকি টিকিট হাউসফুল হওয়ার পর ব্ল্যাকে টিকিট বিক্রি ঠেকানোর জন্য প্রশাসনের নিয়মিত তদারকি চলত সিনেমা হলগুলোর সামনে। তখন ছিল না হাতের মুঠোয় প্রযুক্তির দুনিয়া টা অধরাই ছিল , অর্থাৎ ছিল না স্মার্ট ফোন, তখনও রমরমা বাড়েনি থ্রী জি থেকে ফোর জি নামক প্রযুক্তি অস্ত্রের । আর এই প্রযুক্তির দুনিয়ার বাজার চাঙ্গা হতেই কেমন যেন ঝিমিয়ে গেলো ও ম্লান হয়ে পড়লো বিশেষ করে মফস্বলের সিনেমা হল গুলো ।
শান্তিপুর সুন্দর শ্রী সিনেমা হলের কর্ণধার জহর লাল সাহার সূত্রে জানা যায় ২০১২ সালের পরবর্তী সময় থেকেই এই চলচ্চিত্র ব্যাবসা ঝিমিয়ে পড়ে । শেষ দিকে তিনি জোর করে সেটা চালাতে গেলেও ব্যাবসায় লোকসান হয়ে যায় । তারপর থেকেই শান্তিপুরে এই চলচ্চিত্রের ব্যাবসা বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত নেন তারা । তিনি আরো জানান আনুমানিক ১৯৬০ সালের আগে শান্তিপুরে স্থাপিত হয়েছিল সুশ্রী সিনেমা হল এবং ১৯৭২ সালে তারই নেতৃত্বে স্থাপিত হয় শান্তিপুর সুন্দর শ্রী সিনেমা হল ।
সুন্দর শ্রী সিনেমা হলের প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করতেই ভেসে উঠলো কত স্মৃতি । বিশাল সেই প্রেক্ষাগৃহের দেওয়ালে সেই ঘূর্ণীয়মান পাখা গুলি স্তব্ধ হয়ে যেন গুমরে গুমরে কাঁদছে । হল ঘরের সিলিং এ কারুকার্য খচিত অপূর্ব ডিজাইন , যে দিকে এক নজর দৃষ্টিপাত করলেই বোঝা যেত এটা সুন্দর শ্রী সিনেমা হল । ওপরের ব্যালকনি কার্যত প্রায় অন্ধকার , ব্যালকনিতে কিছু আসতো কিছু ভাঙ্গা চেয়ারের মাঝে পড়েছে ধুলোর আস্তরণ । যেন অশ্রুসজল নয়নে কালের নীয়মে চেয়ার গুলি সিক্ত হয়ে উঠেছে । তবে চেয়ারের পায়ের কাছে এখনো পড়ে সেই দশ পনেরো বছর আগে বিনোদন প্রেমী দর্শকের খাওয়া বাদামের খোলা , খাবারের ঠোঙ্গা , চানাচুরের প্যাকেট । সমস্ত টাই যেন ইতিহাস । সত্যিই কালের নিয়মে সবই সম্ভব। তবে সুন্দর শ্রী সিনেমার প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করতেই বাম দিকে বাড়ির জানলা নির্মাণ করার অ্যালুমিনিয়ামের সরঞ্জাম লক্ষ্য করা গেছে । আবার প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করে ওপর দিকে তাকালেই স্পষ্টই প্রতিয়মান হয়েছে সিনেমা হলের ওপরের টিনের চাল ফুটো হোয়ে গেছে এবং আকাশ দেখা যাচ্ছে ।
অন্যদিকে সুশ্রী সিনেমা হলের দৃশ্যটা ও কার্যত একই রকম । এই সিনেমা হলের মূল ফটকের সামনেই বন জঙ্গলে ভরে গেছে । প্রেক্ষাগৃহের ভিতরে স্থান পেয়েছে বর্তমানে শান্তিপুরে বহুল প্রচলিত ব্যাবসা যন্ত্র চালিত তাঁত এবং বারান্দায় পানিয় জল বহনকারী কিছু জার প্রতিয়মান হয়েছে । সাধারণ ভাবে বোঝাই যাচ্ছে একটি আধুনিক ব্যাবসার কেন্দ্রে পরিণত হতে চলেছে ।
তবে সুশ্রী সিনেমা হল টির সাবেকি মালিকানা ছিল কলকাতা বোস কোম্পানির । কলকাতার বসু ফ্যামিলির পাঁচ ভাই বঙ্গ ভূষণ বসু , ইন্দুভুষণ বসু, ফনি ভূষণ বসু , কান্তি ভূষণ বসু এবং শান্তি ভূষণ বসু ইনারা এবং এদের সহধর্মিণী রা প্রত্যেকেই প্রয়াত । তবে ইনাদের পরবর্তী জেনারেশন সুশ্রী সিনেমা হল টি শান্তিপুর সুন্দর শ্রী সিনেমার কর্ণধার জহর সাহার নিকট বিক্রয় করে দিয়েছিলেন বলেই সূত্রের খবর ।
তত্কালীন সময়ে শান্তিপুর শ্যামবাজারে মোট এক বিঘা জমি পনেরো হাজার টাকার বিনিময়ে কিনে চলচিত্র ব্যাবসা শুরু করেছিলেন জহর সাহা । তবে তার সাথে কথোপকথন সূত্রে জানা যায় এই ব্যাবসা অর্থনৈতিক ভাবে এমন কিছু ঝুঁকি পূর্ণ ছিল না । মূলত তার চলচ্চিত্র চালানোর শখ বা নেশা পরবর্তীকালে পেশায় পরিণত হয়ে ছিল । তবে সুন্দর শ্রী সিনেমা হলে প্রথম সিনেমা ছিল বাংলা ছবি এপার ওপার অন্যদিকে সুশ্রী সিনেমা হলে প্রথম বাংলা ছবি ছিল সেতু ।
তবে বর্তমানে শান্তিপুরে এই সিনেমা হল দুটিতে এল আই সি অফিস , ব্যাংক , বীমা , শপিং মল প্রতিষ্ঠা করার বহুমুখী পরিকল্পনা থাকলেও বর্তমানে এখনও একটিও বাস্তবায়ন হয়নি।