মলয় দে, নদীয়া : বাঙালি হিন্দুদের একটি গুরুত্বপূর্ণ লোক উৎসব হলো চড়ক । চৈত্র মাসের শেষ দিনে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। কবে বা কোন সময় কাল থেকে এই চড়কের অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়ে ছিল তার ধারণা পাওয়া না গেলেও জনশ্রুতি অনুযায়ী বলা যায় ১৪৮৫ সালে সুন্দরা নন্দ নামে এক রাজা এই পুজোর প্রচলন করেছিলেন । তবে রাজ পরিবারের লোকজন এই পুজোর সূচনা করলেও চরক কখনও রাজ রাজাদের পুজো ছিলো না , এটি হিন্দু সমাজের একটি বিশেষ লোক সংস্কৃতি , আর সেই কারণেই এই পুজোর পুরোহিতের প্রয়োজন পড়ে না ।
এই চরক পুজো কে নীল পুজো বলেও অভিহিত করা হয়ে থাকে । এই পুজোর আগের দিন চরক গাছ টি কে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয় । এতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিব লিঙ্গ রাখা হয় । যেটা পূজারীদের কাছে বুড়ো শিব বলে পরিচিত । এই চরক অনুষ্ঠানের বিশেষ অঙ্গ হলো কুমিরের পুজো , জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর দিয়ে হাঁটা , কাঁটা ও ছুরির ওপর দিয়ে লাফানো , শিবের বিয়ে , অগ্নি নৃত্য ও হাজরা পুজো করা ।
উক্ত অনুষ্ঠানের মুলে রয়েছে ভূত প্রেত ও পুনর্জন্মের ওপর বিশ্বাস । চরকের বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রাচীন কৌমো সমাজে প্রচলিত নরবলির অনুরূপ । এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে নানান দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ হিসাবে বিবেচিত ।যেমন মুখে শিক ফোটানো , আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটা , সন্ন্যাসীদের পৃষ্ঠ দেশে লোহার শোলা কা বেঁধানো এবং মাটিতে প্রোথিত চরকের দোলায় উঠে প্রবল থেকে প্রবল তম গতিতে পাক খাওয়া । এই ধরনের নিষ্ঠুর প্রথাগুলি মিলে মিশে রয়েছে বাংলার চরক উৎসবের সাথে ।
তবে এর নেপথ্যে ও প্রাচীন সমাজ ব্যাবস্থার এক মর্মান্তিক কাহিনী রয়েছে । আমাদের বাঙলায় যখন জমিদারি প্রথা ও রাজতন্ত্র বলবৎ ছিল , তত্কালীন সময়ে যে সমস্ত প্রজারা সঠিক সময়ে রাজাকে খাজনা দিতে পারতো না বা কোনো প্রজা সারা বছর খাজনা দিতে অপারক হলে তাকে তার শাস্তি হিসাবে এইভাবে শূলে চড়িয়ে ঘোরানো হতো । আর সেটা করা হতো এই বছরের শেষে । কিন্তু আজ রাজতন্ত্র বলবৎ নেই , নেই জমিদারি প্রথাও তবুও চরক সংক্রান্তির এই উৎসবের মাঝে এই প্রথাকে স্মরণ করার রেওয়াজ আজও বিদ্যমান রয়েছে বর্তমান সমাজে । ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ সরকার আইন করে এই প্রথা বন্ধ করলেও গ্রাম বাংলায় এখনো এই রীতি বলবৎ রয়েছে । আবার অনেক ইতিহাস বিদ ও গবেষকেদের ধারণা গ্রীষ্মের প্রবল দাবদাহে কৃষিভিত্তিক সমাজে চাষীরা নতুন বছরে ভালো ফসল ফলানোর প্রত্যাশায় এই পুজো বা সামাজিক উৎসবের শুভ সূচনা করেছিল । তবে বাঙলার যেখানে যেভাবেই এই অনুষ্ঠান হোক না কেনো এর মূল আবহ জুড়ে রয়েছে কৃষি দেবতা বা ভগবান শিবের আবাহন । পশ্চিমবঙ্গের কৃষি ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় এখনো এই উৎসব বলবৎ রয়েছে। এইরকমই নানা উপাচারের সাক্ষী হয়ে ছিলাম আমরা, শান্তিপুর শহরের রামনগর মাঠ এবছর 52 তম বড়শি বেঁধানো চড়ক অনুষ্ঠিত হলো এ বছর। উদ্যোক্তারা জানান করোনা পরিস্থিতির জন্য ৭২ জন এর বদলে এবছর ৩৬ জন । আর বড়শি ফুটিয়েছে তিনজন।