মলয় দে, নদীয়া :-বিয়ের মরসুম চলছে! হেঁইয়াহো… হেঁইয়া হো… বলতে বলতে জনা ছয়েক পালকি বাহক, নতুন ধুতি গেঞ্জি পরিহিত এবং কোমরে গামছা বেঁধে কাঁধে পালকি তুলে ডুলকি তালে, নববধূকে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন বরের বাড়ির উদ্দেশ্যে। পাশে ঢোলক তাশা ব্যঞ্জনের মত বাজনার তালে তালে পা মিলিয়ে এগিয়ে চলেছেন কিছু লোক।
নদীয়ার হাঁসখালি থানার বগুলা শিলবেড়িয়া অঞ্চলের দিলীপ কুমার সাহা মেয়ের শখ পূরণে বিবাহ মন্ডপ নির্মাতার সহযোগিতায় বহুকষ্টে খুঁজে পেয়েছেন নদীয়ার শান্তিপুরের কল্যাণ পালকে। কল্যান বাবু নাট্যকর্মী তাই সংস্কৃতির ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্যই দীর্ঘ কুড়ি বছর যাবৎ পালকি, রনপা ,মহিলা ঢাকি, ঘোড়া, কুলো নাচ, নানা উপাচার এর ব্যবস্থা করে থাকেন, যাকে বর্তমান হাল ফ্যাশনের ভাষায় ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট বলে থাকি আমরা।
সেই দ্বাদশ থেকে ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত বিয়ের বাজারে বাহন হিসাবে পালকির কোন জুরি ছিল না। মোটর গাড়ির সাথে পাল্লা দিতে না পারায় বর্তমানে পাড়ি দিচ্ছিলো ইতিহাসে, কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা অভিনবত্বের এক্সকুলুসিভ খুঁজতে গিয়ে, কিছু না পেয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসছেন সেই সাবেকিয়ানা। খাদ্য বস্ত্র জীবনযাত্রা বাসস্থান জীবিকা সবক্ষেত্রেই ফিরে আসছে পুরাতন।
এই নদীয়াতে সেন রাজাদের রাজধানী নবদ্বীপে একসময় বহু রাজা জমিদারেরা বাস করতেন। উৎসব অনুষ্ঠানে জাকজমকের অন্যকে টেক্কা দিতে ফিটন পালকি ঘোড়া হাতি নিয়ে শোভাযাত্রাসহ বর-বউ নিয়ে আসার প্রথা এখানে বহুকালের। শোভাযাত্রায় প্রথমের দিকে ব্যবহৃত হতো মশাল পরবর্তীতে গ্যাস বাতি, বেলোয়ারী ঝাড় বাতি।
পালকি শব্দটি সংস্কৃত “পলঙ্ক” বা “পর্যঙ্ক” থেকে উদ্ভূত। পালি ভাষায় এই যানের নাম “পালাঙ্কো”। হিন্দি ও বাংলায় এই যান পালকি বলেই পরিচিত। স্থান ভেদে ডুলি, শিবিকা নানা নামে জানেন অনেকে। রামায়ণে পালকির উল্লেখ আছে, বিখ্যাত পর্যটক ইবনবতুতা, এবং জন ম্যাগনোলি ভ্রমণের সময় পালকি ব্যবহার করতেন বলেই জানা যায়। ভারতের প্রাক স্বাধীনতার মুহূর্তেও ইংরেজদের পালকির ব্যবহার চোখে দেখেছি আমরা। এক সময় অসুস্থ রোগীকে বৈদ্য কবিরাজ বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার চল ছিলো। ধারণা করা হয় স্লেজ চালিত গাড়ির ধারণা থেকেই সৃষ্ট এই যান। ইউরোপ পরবর্তী পারস্য এবং মিশরীয় চিত্রকর্মে ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায় যথেষ্ট ভাবে। রোমে সম্ভ্রান্ত মহিলাদের যাতায়াতের জন্য এবং চীনে সনাতনী ধারায় এই জানে সিড্যান চেয়ারের উপযোগিতা রয়েছে।