জেনে নিন,জগদ্ধাত্রী মাতার প্রথম পূজোর ইতিহাস

Social

নিউজ সোশ্যাল বার্তা , মলয় দে, নদীয়া:-চন্দননগর কৃষ্ণনগর, বাংলা সহ বিভিন্ন জায়গায় সাড়ম্বরে পূজিত হন জগদ্ধাত্রী মাতা। আলোকসজ্জা, মন্ডপ সজ্জা, সুবিশাল প্রতিমা দেখে অভ্যস্ত সকলেই। কিন্তু কোথায় কবে কিভাবে প্রথম পূজিত হয়েছিলেন মাতা জগধাত্রী?

শান্তিপুর শহর ছাড়িয়ে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরের এক প্রাচীন জনপদ ব্রহ্মশাসন। এক সময়ে এখান দিয়েই প্রবাহিত হত ভাগীরথী। কথিত আছে নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের হাত ধরেই নদিয়ায় প্রথম জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা হয়। তারই পৌত্র গিরীশচন্দ্র রায় তার জমিদারির অন্তর্ভুক্ত শান্তিপুরের হরিপুর গ্রামের পার্শ্ববর্তী এই অঞ্চলে ১০৮ ঘর ব্রাহ্ম পরিবারকে বসবাসের জন্য জায়গা দেন। আর তার থেকেই এই গ্রামের নাম হয় “ব্রহ্মশাসন”।

এই প্রসঙ্গে একটু ফিরে যেতে হয় ইতিহাসের পথ ধরে। ১৭১৫ থেকে ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন নদীয়ারাজ রঘু রায়,তারপর ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে নদীয়ার রাজা হন কৃষ্ণচন্দ্র রায়। কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে তখন বেশ আড়ম্বরের সাথে পুজিতা হতেন দেবী দুর্গা যিনি রাজ রাজেশ্বরী নামে পরিচিত। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদৌল্লার সাথে যখন মীরজাফর এর বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছিলো তখন রাজনৈতিক স্বার্থে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে মীরজাফরকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেন নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে মীরজাফর কে সরিয়ে যখন বাংলার মসনদ দখল করেন তার জামাতা মীরকাশিম তখন তার সাথে বিরোধ বাঁধে নদীয়ারাজ এর। নবাবের বকেয়া কর পরিশোধ করতে না পারার কারণে মীরকাশিম বন্দী করেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কে এবং তাকে পাঠানো হয় বিহারের মুঙ্গের জেলে। ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে জেল থেকে পালিয়ে আসেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এবং জলপথে কৃষ্ণনগর এর উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ফেরার পথে বর্তমানে নদীয়া জেলার রুকুনপুর অঞ্চলে তিনি দেখেন গঙ্গাবক্ষে দুর্গপ্রতিমা নিরঞ্জনের দৃশ্য। দেবী দুর্গার পুজো না করতে পারার কারনে খুব ব্যথিত হন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। সেই রাতেই কৃষ্ণনগর রাজবাড়ী তে পৌঁছে রাজা স্বপ্নাদেশ পান দেবীর। স্বপ্নে দেবী আদেশ দেন আগামী শুক্লা নবমী তিথিতে দেবী পূজার আয়োজন করতে হবে এবং সেই দেবী জগদ্ধাত্রী নামে পুজিতা হবেন। মোহিত রায় সম্পাদিত “নদীয়া কাহিনী” নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে সেই সময় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে দেবী জগদ্ধাত্রীর রূপের কোনো ধারণা না থাকার কারনে ১৭৬৩ সালে তাঁর হাত ধরেই কৃষ্ণনগর রাজবাড়ী তে প্রথম দেবী জগদ্ধাত্রী র পুজো শুরু হয় মঙ্গলঘটের পুজোর মাধ্যমে।

এরপর ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণচন্দ্র রায় এর পৌত্র গিরিশচন্দ্র রায় যখন নদীয়ার অধিপতি হন তখন তার রাজসভায় সভাপন্ডিতের পদ অলংকৃত করতেন চন্দ্রচুড় তর্কচূড়ামনি, ১০৮ ঘর ব্রাহ্ম দের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম এবং তিনি ব্রহ্মশাসন গ্রামে বসবাস করতেন গিরিশ্চন্দ্রের আমলে এবং ভাগীরথীর তীরে পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে তন্ত্রসাধনা করতেন। কথিত আছে, তত দিনে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন হয়েছে,কিন্তু দেবীর কোনো নির্দিষ্ট রূপ এবং পুজার পদ্ধতি বা মন্ত্র ছিল না। গিরীশচন্দ্রই চন্দ্রচূড়কে অনুরোধ করেন সাধনার মাধ্যমে দেবী জগদ্ধাত্রীর রূপের সন্ধান এবং পুজোর জন্য প্রয়োজনীয় পদ্ধতি এবং মন্ত্রের অন্বেষণের। এর পরে ধ্যানে বসেন চন্দ্রচূড়। আর সাধনায় বসে একদিন ব্রাহ্ম মুহূর্তে দেবীর মৃন্ময়ী রূপের দর্শন পান তিনি, সে দেবীর গ্রাত্রবর্ন ছিলো ব্রাহ্মমুহূর্তের রং অর্থাৎ ঊষাকালে সূর্যের রং এবং তিনি ছিলেন সিংহবাহিনী চতুর্ভুজা। কথিত আছে, সেই সাধনাতেই পুজোর পদ্ধতি এবং মন্ত্রের হদিশ পান চন্দ্রচূড়। এর পরে সেই পদ্ধতি মেনেই দেবীর সেই ঊষাবর্ণা মৃন্ময়ী রূপ সৃষ্টি করে তিনি ব্রহ্মশাসনে পুজো শুরু করেন। সম্ভবত ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দ থেকেই কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে মহা আড়ম্বরের সাথে দেবীর মৃন্ময়ী রূপের আরাধনা শুরু হয়। আর পরবর্তীকালে সেই পদ্ধতি অনুসরণ করেই, সেই চিরাচরিত পুজো পদ্ধতি সেই চিরাচরিত পরম্পরা মেনেই জগদ্ধাত্রী পুজো হয়ে আসছে ব্রহ্মশাসন সহ শান্তিপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ীর নাটমন্দির থেকে শুরু করে পরবর্তীতে এই পুজো ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে শান্তিপুর, চন্দননগর থেকে বাংলার এবং বাংলার বাইরে আপামর বাঙালি সমাজের কাছে।

Facebook Page: News Social Barta 24×7