কলমে: অরুণজিৎ দত্ত,নদীয়া : জগদ্ধাত্রী নামের আভিধানিক অর্থ হলো – যিনি জগৎ কে ধারণ করে রেখেছেন ।কৃষ্ণনগরকে ঘিরে শ্রী শ্রী জগদ্ধাত্রী পুজো প্রচলনের সুপ্রাচীন ইতিহাস আছে । অষ্টাদশ শতকে নদিয়ার রাজা শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র রায় তাঁর রাজধানী, আজকের নদিয়া জেলার সদর শহর কৃষ্ণনগরে প্রথম এই জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেন । তারপর থেকেই এই পুজোর জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে । দূর্গার আরেক রূপ এই জগদ্ধাত্রী । তাই কৃষ্ণনগরের মানুষের শারদ উৎসব দেবী দূর্গা মায়ের বন্দনা দিয়ে শুরু হলেও তা শেষ হয় জগদ্ধাত্রী পুজো দিয়েই ।
ধীরে ধীরে রাজবাড়ির দেখাদেখি রাজার প্রজারাও রাজবাড়ির বাইরেও এই পুজোর আয়োজন করেন। কথিত আছে ১৭৭২ সালে স্থানীয় গোয়ালারা দুধ বিক্রি করে কৃষ্ণনগরের চাষাপাড়ায় এইধরণের জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেন যা পরবর্তীতে ‘বুড়িমা’র পুজো নামে পরিচিতি লাভ করেছে । এই পুজো শুরু হয়েছিল ঘটে ও পটে । ১৭৯০ সাল নাগাদ গোবিন্দ ঘোষ ঘট-পটের পরিবর্তে মূর্তি গড়ে জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা করেন।
তাহলে সময়ের সাথে সাথে নিশ্চিতভাবে ঐতিহ্যের পরিবর্তন ঘটেছে কালের নিয়মেই । করোনা মহামারী কালীন আজকের পরিস্থিতিতেও তাই এই পুজোয় নতুন কিছু পরিবর্তন আনা ভীষণ প্রাসঙ্গিক। করোনা প্রমাণ করেছে সুদীর্ঘ লকডাউনের যাত্রা পথে মূর্তিরূপে মন্দিরে ভগবান, গির্জায় গড, মসজিদে আল্লা আরো দশজন অতি সাধারণ মানুষের মতোই ঘরবন্দী ছিলেন । শুধুমাত্র নিজেদের সচেতনতা আর চৈতন্য জাগ্রত করেই এই মহামারী থেকে আমরা নিস্তার পাওয়ার রাস্তা খুঁজে চলেছি । এখন প্রশ্ন আমাদের এই চৈতন্য উদয় কোথায় হয় ?- একমাত্র নিজেদের চিত্তেই, চেতনাতেই।তাহলে যাঁর কৃপায় আমার চৈতন্য জাগ্রত হবে তাঁর অধিষ্ঠানও একমাত্র আমাদের চিত্ত-ই । আর করুণাময়ী “মা ” তিনি তো করোনার কলি কালে সবাইকে তাঁর এই প্রকৃত অবস্থান দেখিয়েই দিলেন।
তবে এতো বাহ্যিক আড়ম্বর কিসের ? এই দুর্দিনে এসবই তো নিষ্প্রয়োজন। আমাদের সংসারে সন্তান অসুস্থ থাকলে তার দুঃসময়ে পিতা-মাতা কি কোনো শুভ উপলক্ষ্যে আনন্দ উৎসবের আয়োজন করতে পারেন ? না আনন্দের উৎসবে অংশ নিতে পারেন ? তাহলে যিনি আমাদের এই জগৎ ধারণ করে আছেন – স্বয়ং জগদ্ধাত্রী – তিনি তো সকলের “মা”, তিনি আজ আমাদের দুর্দিনে কি করে কোনো উৎসবে সামিল হয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হবেন ? সে তো মাতৃত্বের ধর্মবিরুদ্ধ হবে! তারপরও তাঁকে আমরা মণ্ডপে, বারোয়ারিতে, ক্লাবে সর্বত্র বসিয়ে আড়ে- বহরে, জাঁকজমকে বাড়িয়ে তুলছি। তবে আমরা আসলে কার প্রতিপত্তি প্রমাণে এতো ব্যস্ত হচ্ছি ? আজকের পুজোর যেন একটাই উদ্দেশ্য – ‘আমাকে দেখো’ । ক্লাব, বারোয়ারি, পুরুষ-নারী, ব্যক্তি নির্বিশেষে সকল মানুষের একটাই বাসনা- শুধু ‘আমাকে দেখো’। আমরা সব্বাই সেজে-গুজে, সাজিয়ে -গুছিয়ে, জাঁকিয়ে প্রমোট করে যাচ্ছি যেন নিজেদের মুখ আর ক্ষমতাকে । সব্বাই রাস্তায় নেমে পড়েছেন পুজোর নামে ‘আমাকে দেখো’ র বিজ্ঞাপনে । এখানে ঐতিহ্য নয়,পুজো নয়, নিজেদের অজান্তেই আমরাই যেন জেনে বা না জেনে সক্কলকে অহেতুক আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে তুলছি প্রতিনিয়ত । শুধুই প্রচার করে চলেছি সব চেয়ে সুন্দর আমি, আমার পাড়া,আমার ক্লাব, আমার গোষ্ঠী, আমার দল । সবাই উঠে পড়ে লেগেছি জাহির করতে আমাদের ক্ষমতা-অর্থ-বল-প্রতিপত্তি। তাই নিজের,নিজের ভারী আপনজনদের ক্ষতি, অসুখ,মৃত্যু সমস্ত ভয়কে উপেক্ষা করে আড়ম্বরকে আঁকড়ে ধরেছি আমরা উৎসবের নামে নিজেদের আমোদ-প্রমোদ আর ফুর্তি চরিতার্থ করতে ॥ আর তাকেই ঐতিহ্যের তকমা দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছি যাতে কেও কোত্থাও তাতে বাধা না দেয় । আর বারবার ভুলে যাচ্ছি পুজোটা আমার বা আমাদের নয়, পুজোটা “আমার” বা “আমাদের” শব্দটির মধ্যে যে ‘মা’ শব্দটি লুকিয়ে আছে, সেই মায়ের ।
পুজো মানে তো আমাদের আরাধ্যের প্রতি আমাদের আত্ম-নিবেদন – যেখানে শুধুমাত্র আত্মিক সমর্পন থাকবে ঈশ্বরের কাছে । পুজোর আয়োজনে স্বতঃস্ফূর্ত সামিল হবে মানুষ। আয়োজকদের সাথে আত্মিক আনন্দে জুড়ে যাবেন তাঁরা । কেও বাড়ি থেকে নিয়ে আসবেন ফুল, কেও গাছের ফল, এলাকা ভিত্তিক একটি পুজোতে সব মানুষ একাত্ম হয়ে উঠবেন। বারোয়ারির পুজো হবে ঘরের পুজো। পাড়ার ছেলে মেয়েরা নিজেদের নাচে, গানে, আঁকায় ইত্যাদি, প্রভৃতি নানান পারদর্শিতায় পুজা মণ্ডপকে করে তুলবে এক আনন্দমেলা । রক্তদান শিবিরের আয়োজন হবে – তবেই তো মানুষে মানুষে হবে আত্মিক মিলন । এই তো ছিলো আমাদের পুজোর আসল ঐতিহ্য, উদ্দেশ্য।
যদি কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর আদি ঐতিহ্য ধরে রাখতে হতো তবে তো একমাত্র ঘট্ ও পট পুজো অথবা রাজবাড়ির আদলে তৈরী শান্ত, সিন্গ্ধ, ছোটো মাতৃ মূর্তি পুজো দিয়েই তা একমাত্র টিকিয়ে রাখা সম্ভব ছিলো, কিন্তু আমরা তা পেরেছি কই?
ঐতিহ্যের কথা বলতে গেলে বারোয়ারি পুজোর আয়োজন শুরু হয়েছিল মানুষের স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ ও সদিচ্ছায় অর্থদানের মধ্যে দিয়েই । কিন্তু সে ঐতিহ্যও তো বিনষ্ট হয়েছে “চাঁদা” প্রথা চালু হয়ে, আর আজ তো তা “তোলা” আদায়ে রূপান্তরিত হয়েছে । কোথাও কোনো ঐতিহ্যকেই টিকিয়ে রাখতে পারছি কি আমরা? নিজেদের রুচি, মর্জি আর সুবিধামতো তা অনবরত পরিবর্তন করে চলেছি ।
সকল পরিবর্তনই যদি জগতের নিয়মেই হয়, তবে আজ ব্যক্তি, গোষ্ঠী সকলের স্বার্থে এই মহামারীর অসুখ কালে যে কোনো শুভ পরিবর্তন মেনে নিতেও আমাদের আপত্তি থাকার কোনো কারণ নেই ।
সব ক্লাব, বারোয়ারি বা গোষ্ঠী তাঁদের সংগৃহীত অর্থ দিয়ে এবারের পুজো না হয় ছোট্ট করেই একটু বেশী আন্তরিক ভাবে করতেন আর বাকি অর্থ না হয় মুক্তহস্তে দান করতেন পুজোর সাথে সরাসরি যাঁদের জীবিকা যুক্ত সেই সব ঢাকি, বাদ্যিবাদক, সাঙয়ের বেয়ারা, মৃৎশিল্পী, রাঁধুনি, আলোক ও প্যান্ডেল সজ্জাকারী, চালি ও ডাকের সাজের সকল কর্মীদের মধ্যে l তাতেও কী কম আনন্দ হতো ? হ্যাঁ এতে হয়তো ‘আমাকে দেখো’র জাঁকজমক, ফুর্তি, উল্লাস, আমোদ- প্রমোদ মলিন হয়ে যেতো । বৃহৎ আকারে উজ্জ্বল হতো মানবিকতার মুখ আর মানুষের পুজো ।
মানুষের জন্যেই যদি উৎসবের আয়োজন হয় তবে মানুষে মানুষে আত্মিক মিলনের এর চেয়ে ভালো পন্থা আর কিই বা হতে পারে ? এই তো সেই ঈশ্বর জ্ঞানে জীব সেবা । এই সেবা দানের মধ্যে দিয়েই আমি, আমার পাড়া, আমার বারোয়ারি, আমার ক্লাব সবাই তখন বুক চিতিয়ে স্বগর্বে বলতে পারবো – ‘আমাকে দেখো’ । প্রত্যেকের অন্তরে প্রতিযোগিতা চলতে থাকুক কে কতো বেশি করে মানুষের সেবা দান করবেন । সংকট কালে আজ অগণিত মানুষ কর্মহীন, দ্রব্যমূল্য আকাশ ছোঁয়া । আর্থিক অস্বচ্ছলতায়, রোগ-শোকে আজ অধিকাংশ মানুষ জর্জরিত, ভীত, তঠস্থ । সেখানে সব ধরণের আড়ম্বর বন্ধ রেখে, কোনো অপচয় না করে শুধুমাত্র আর্তের সেবাদানের মধ্যে দিয়ে আজ আমরা কি পারি না আমাদের প্রকৃত গৌরব-প্রতিপত্তি জাহির করতে !! তাতেও তো মানুষ আমাকে, আমাদেরকেই চিনবে । তখন আর কাউকে সেজে-গুজে, বিশাল আয়োজন করে, ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, লোক খাইয়ে, বাইরে থেকে শিল্পী ভাড়া করে এনে অনুষ্ঠান করে দেখিয়ে বলতে হবে না – ‘আমাকে দেখো’ । সব্বাই আপনা হতেই মণ্ডপে মণ্ডপে অনুভব করবেন পুজোর মাহাত্ম- যেখানে যত সেবা সেখানে ঈশ্বর হবেন ততো জাগ্রত ।
আর যিনি জগতের ধারণকর্ত্রী তিনি যদি দেখেনে তাঁর সকল সন্তান সুখে আছেন, প্রত্যেকে আছেন পরের তরে তাঁর কৃপালাভে কি আর আমাদের বিলম্ব থাকবে ? সন্তান কে সুখী দেখে কোন মায়ের বুক না আনন্দে ভরে! নিজের সব রকম সখ-আল্হাদ, আড়ম্বর বিসর্জন দিয়েই তো সংসারে মায়েরা তাঁর সন্তানকে সর্বসুখ বিলিয়ে দিতে চান । তাহলে আজকের দুর্দিনে মায়ের পুজোয় যদি আমরা আড়ম্বর, অতিরঞ্জন বাদ দিয়ে তা আর্ত-পীড়িতের সেবায় লাগাতে পারি, তাঁদের পরিবারের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারি পুজোর দিন গুলোতে তাতে কি মা কোনোভাবেই রুষ্ট হতে পারেন ? বরং তিনি তো তখন দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে আনন্দে দু’হাত ভরে তাঁর অনন্ত স্নেহাশিস বর্ষণ করবেন তাঁর সকল সন্তানকে ।
যিনি নিজেই স্বয়ং অপার সৌন্দর্য, ক্ষমতা আর ঐশ্বর্য্যের অধিকারিণী তাঁকে দেখতে তো এমনিতেই মানুষের ঢল নামবে । তাঁকে তো বলতে হবে না -‘আমাকে দেখো’ । তাহলে তাঁকে আমরা নতুন করে কি দিয়ে সাজিয়ে আর লোক দেখাতে যাবো ? তাই এবার থেকে মাইকে প্রচার করে নিষ্প্রয়োজনে মায়ের গয়না,বস্ত্রের অনুদান প্রার্থনা ও প্রচার বন্ধ হোক । শুরু হোক আর্তের সাহায্যার্থে অনুদান গ্রহণের প্রচার।
তখন আর কৃষ্ণনগরের পুজো শুধু কোনো ধর্মীয় আনুষ্ঠান নয়, জ্যান্ত ভগবানের পুজোর পীঠস্থান বলে পরিচিতি পাবে । এই নবজাগরণের মধ্যে দিয়ে কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর এক নতুন ঐতিহ্যবাহি অধ্যায়ের সূচনা হবে । যেখানে সমস্ত মণ্ডপে মণ্ডপে শ্রী শ্রী জগদ্ধাত্রী থাকবেন স্বয়ং বিরাজমান । দিকে দিকে এই উৎসব উজ্জাপনে আগ্রহ বাড়বে । গোটা দেশকে, বিশ্বকে এক নতুন চিন্তা চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তুলবে কৃষ্ণনাগরিকেরা । বহু মহামানবের ধূলিধন্য এই পবিত্র শহর এক নতুন ইতিহাস রচনা করবে তার গৌরবান্বিত ঐতিহ্যকে সম্বল করে । চিরতরে জগৎ সভার শ্রেষ্ঠ জগদ্ধাত্রী শিরোপা ছিনিয়ে নিয়ে আসবে কৃষ্ণনগরবাসী ।