মলয় দে, নদীয়া: একপাশে পীরের মাজার তার পাশেই গড়া নদীয়া জেলার শান্তিপুর সূত্রাগড় পীরের হাট অঞ্চলের জগদ্ধাত্রী মন্ডপ । প্রায় তিনশো বছরের আগে এই অঞ্চলে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন হয় । এই পীরের হাট অঞ্চলে হিন্দু ও মুসলিম এক সঙ্গে বসবাস করত। দুই সম্প্রদায়ের মেলবন্ধনের জন্য এই পুজো জড়িয়ে আছে। শান্তিপুরের জগদ্ধাত্রী পুজো গুলির মধ্যে সর্বাপ্রেক্ষা প্রাচীন এই বারোয়ারীর জগদ্ধাত্রী পুজো,ওই এলাকায় একটি পীরের মাজার ও রয়েছে কথিত আছে, সেটিও প্রায় তিনশো বছরের পুরোনো। মাজারের পাশে হাট বসতো তার থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয় পীরের হাট ।
কথিত আছে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় দেবীর জগদ্ধাত্রীর স্বপ্না দেশ পেয়ে তিনি প্রথম তার বাড়িতে দেবীর পুজো করেন। দেবীর পুজোর মাহাত্ম্য ছড়াবার জন্য তিনি পরবর্তী কালে তার লেঠেলদের সহযোগিতায় মহারাজ তার হাতিশালায় জগদ্ধাত্রী পুজো করেন ,(পীরের হাট অঞ্চলে টি আগে রাজার হাতিশাল ছিল)। অঞ্চলের লোকেরা মনে করেন এখনো একটি হাতির কবর এই অঞ্চলে দেওয়া আছে ,এর পর থেকে এক এক ভাবে শান্তিপুর তথা গোটা জগতে দেবীর পূজার প্রচলন হয়। যেহেতু মহারাজ স্বয়ং এই পূজা করেছিলেন সেহেতু সেই রীতি বজায় রেখে আজ ও মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের নামেই এই পূজার সংকল্প হয়। দেবীর নির্দেশে মহারাজ একদিনে তিন পূজা সমাধা করেছিলেন বলে এখনও পর্যন্ত পুরোহিত একই দিনে দেবীর সপ্তমী ,অষ্টমী ,নবমী পূজা সমাধা করেন ।ঊষা কালে পুরোহিত দেবীর পূজায় বসেন এবং তা শেষ হতে হতে প্রায় রাত্রি হয়ে যায় ।এই পূজা করে থাকেন শান্তিপুরের স্বনামধন্য পুরোহিত শ্রী সব্যসাচী পাঠক। তিনি ও বংশ পরম্পরায় এই পূজা করে থাকেন।দেবীর রূপ এখানে পীতবর্ণা , ত্রিনয়না , চর্তুভূজা , সিংহবাহিনী এবং দেবীর পদতলে শায়িত করিন্দ্রাষুরের ছিন্ন মস্তক ।
এই বারোয়ারীর প্রধান বৈশিষ্ট্য দেবীর পিছনের চালচিত্র , তা পাড়ার সমস্ত যুবক বহুদিন ধরে তৈরী করেন,এ ছাড়াও আরো বৈশিষ্ট্য হচ্ছে , মহাসমারোহে দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয় । দেবীর সামনে ইক্ষু ,কদলী ও কুস্মান্ড বলি দেওয়া হয় ।এ ছাড়াও প্রধান বৈশিষ্ট্য হল যতক্ষণ পূজা চলে ততক্ষন (প্রায় ১৫-১৬ ঘন্টা) দেবীর হোমকুন্ডে হোম সম্পাদিত হয় । এছাড়াও ভোগের বিশেষত্ব হল , দেবীর ভোগ দর্শন । খিচুড়ি, চচ্চরী, পুষ্পান্ন, পরমান্ন, বিভিন্ন ভাজা , চাটনী ,মিষ্টি ইত্যাদি দিয়ে দেবীর ভোগ রাগ হয় ।এক দিনে তিন পূজায় তিন বার ভোগ নিবেদন করা হয় ।এ ছাড়াও দেবীর চন্ডীপাঠ অনুষ্ঠান হয় । বহু দূর দূরান্তের মানুষ মনোবাঞ্ছা পূরোনের লাভে দেবীর সামনে ধূনো পোড়ান , দন্ডী কাটেন । শান্তিপুরের সিদ্ধেশ্বরী মা অত্যন্ত জাগ্ৰতা , তিনি শান্তিপুরের অভিভাবক তাই এই বারোয়ারী থেকে একটি বড়ো নৈবেদ্য জলপান নিয়ে যাওয়া হয় বাদ্য বাজনা সহযোগে ।এই বারোয়ারীর মা বয়সে ও মূর্তিতে বড়ো বলে অনেকে দেবীকে “বড়ো মা” বলেও সন্মোধন করেন।এই দেবীর অনুরূপ আরো একটি জগদ্ধাত্রী মায়ের মূর্তি আছে, তিনি শান্তিপূর সূত্রাগড় অঞ্চলের ” ছোট মা”। দুটি মূর্তি প্রায় একই দেখতে , একজন” ছোট মা “ও অপর জন “বড়ো মা”। প্রতি বছর ছোট মা নিরঞ্জনের পূর্বে বড়ো মা কে দেখতে আসেন। একাদশী তিথিতে দেবীর নিরঞ্জন হয় ,আগে মুর্শিদাবাদ থেকে বেয়ারারা কাঁধে করে নিরঞ্জন করত কিন্তু এখন তা আর সম্ভব হয় না ।এখন ট্রাকটারে করে বির্সজন হয় ।এই পীরের হাট অঞ্চলের মধ্যে একটি প্রকান্ড তেঁতুল গাছ আছে , রীতি অনুযায়ী নিরঞ্জনের পূর্বে দেবীকে মন্দির থেকে বার করে ওই তেঁতুল তলায় বিশ্রাম দেওয়া হয় । পরে বাদ্য বাজনা , আলোর রোশনাই সহযোগে দেবীর নিরঞ্জন সম্পূর্ণ হয়।