ড. মিলন রায়
(সহ: অধ্যাপক, আনন্দ মোহন কলেজ)
তপসিলি উপজাতি বলতে বোঝায় প্রাচীন পারিবারিক বা সম্প্রদায় গোষ্ঠী , যারা সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় এবং রক্তের সম্পর্কে পারস্পরিকভাবে যুক্ত এবং যাদের নিজস্ব সাধারন সংস্কৃতি, ভাষা এবং নেতৃত্ব আছে। ১৯৭১ সালের আদমসুমারি অনুযায়ী ভারাতের মোট উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪ কোটির কাছাকাছি। সমগ্র ভারতে ৪২৭ টি গোষ্ঠীতে ছড়িয়ে এবং এদের ৯১.৭% প্রধানত প্রান্তিক পাহাড়, জঙ্গল ঘেরা গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে। বর্তমানে এদের মোট সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি। বিশিষ্ট সমাজতাত্তিক বিরজা শঙ্কর গুহ সমগ্র ভারতের উপজাতিদের প্রোটো-অস্টোলয়েড, নিগ্রো-বটু ও মঙ্গোলীয় এই তিনভাগে ভাগ করেছেন। তবে নৃতাত্ত্বিক ভাবে পার্থক্য থাকলেও এই তিন গোষ্ঠীর সামাজিক আচার ব্যবহারে অনেক সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। ব্রিটিশ শাসনকালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রুপায়ন তাদের স্বাধীন স্বনির্ভর গ্রামীণ জীবনে এক ভয়ঙ্কর সর্বনাশা অন্ধকার নিয়ে আসে। তার উপর দেশীয় সুদখোর মহাজন, বানিয়া সম্প্রদায় তাদের সরলতার সুযোগ নিয়ে তাদেরকে নিঃস্ব করে দেয়। বহুদিনের এই চরম দারিদ্র ও বঞ্চনার পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল তাদের বিভিন্ন বিদ্রোহ ও আন্দোলনের মধ্যদিয়ে। নিষ্ঠুরভাবে এই আন্দোলন দমনকরে বহু উপজাতি গোষ্ঠীকে ‘অপরাধপ্রবণ জাতি’ (Criminal Tribe) বলে আখ্যা দেয়। এছাড়া একাধিক আইন প্র্রনয়ণ করে জমি, অরণ্য ও অনান্য প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর তাদের চিরাচরিত অধিকারকে খর্ব করা হয়েছিল।
স্বাধীনতার পর সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তপশিলে আদিবাসীদের কল্যানার্থে বিশেষ সংস্থান করা হলেও তাদের বিপুল ক্ষমতার অসাম্য এই ধারনাকে বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। আধুনিকতা, শিল্পোন্নয়ন, খনিজসম্পদ আহরণ, বাঁধনির্মান প্রভৃতি বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের থাবা তারা তাদের ভূখণ্ড কে গ্রাস করে। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী ১০ কোটির বেশি আদিবাসী এইসব কারনে তাঁদের জীবিকা হারিয়েছেন ও নিজ বাসস্থান থেকে উৎখাত হয়েছেন।
পেসা PESA (Panchayat Extensions to Scheduled Areas Act) আইনের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত হয়ে আসা আদিবাসীদের নানা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হলেও তা সম্পূর্ণরূপে কার্যকর হয়নি। বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আদিবাসী সদস্য কম হওয়ায় তারা তাদের বিশেষ সুযোগ সুবিধাগুলিও পান না। ১৯৮৯ সালের লোকসভার ৫৪৩ টি আসনের মধ্যে তপশিলী উপজাতিদের প্রতিনিধিদের জন্য সংরক্ষিত ছিল ৪০ টি আসন। আর সমস্ত রাজ্য বিধানসভা গুলিতে ৩৯৯১ টি আসনের মধ্যে ছিল ৫২৭ টি। আদিবাসীদেরকে আর্য-ভারত অবজ্ঞাভরে পাহাড়িয়া, বুনো, জংলী ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষিত করে থাকে। হিন্দু সমাজের জাতের সিঁড়ির কয়েকটি ধাপে কিছু আদিবাসী ঠাই গ্রহণ করলেও তারাও হিন্দু সমাজে অস্পৃশ্য। মহাভারতের সময় থেকে আজ পর্যন্ত এমন খুব বেশী প্রমাণ পাওয়া যায় না, যাতে ভারতের আদিবাসীকে সভ্য শিক্ষিত ভারতবাসী আপন করে নিয়েছে। তাছাড়া যে আভিজাত্যের গর্বে আদিবাসী সমাজকে তারা দূরে সরিয়ে রেখেছিল, আজও সেই ব্যবধান বিদ্যমান। ফলে কমছে আদিবাসী, বিলুপ্ত হচ্ছে তাদের সংস্কৃতি।
ছবি ঋণ : গুগোল