দেবু সিংহ ,মালদা : পায়ে টানা রিকশার অবলুপ্তির সাথে সাথে টোটো বা ইলেকট্রিক রিক্সার ভিড় বেড়েছে গ্রামেগঞ্জে ও। হারিয়ে যাচ্ছে পায়ে টানা তিন চাকার রিকশা। ব্যতিক্রম নয় মালদা জেলার হরিশ্চন্দ্রপুর। মালদা জেলার হরিশ্চন্দ্রপুর এর বেশিরভাগ রিকশাচালকরা পেশা বদলেছে। এদের মধ্যে বহুলাংশেই টোটো কিনে জীবিকা নির্বাহ করছেন। অনেকেই অন্যান্য পেশায় ঢুকে গেছেন।
কিন্তু এখনো হরিশ্চন্দ্রপুর সদর এলাকায় পায়ে টানা রিকশা নিয়ে এখনো জীবিকা নির্বাহ করছেন আশি বছরের বৃদ্ধ শেখ দুলাল, বাড়ি মালদা জেলার হরিশচন্দ্রপুর 1 ব্লকের সংগঠন পাড়া এলাকায় | পুঁজির অভাবে পেশা বদলাতে পারেন নি। ইচ্ছে ছিল বৃদ্ধ বয়সে কিছু টাকা পয়সা পেলে আর রিক্সা টানবেন না। তিনিও টোটো কিনে অসুস্থ বৃদ্ধা স্ত্রীকে নিয়ে সংসার চালাবেন। সেটা সম্ভব হয়নি।
লকডাউন এর মধ্যেও সংসারের হাল ধরতে মাঝেমাঝেই রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হচ্ছে তাকে। অন্য সময় স্থানীয় একটি বেসরকারি নার্সারি স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য স্কুল ভ্যান চালান। কিন্তু সেখান থেকে যা মাসোহারা পান তাতে ২ বৃদ্ধ বৃদ্ধার মুখের গ্রাসাচ্ছাদন হয়না। বাধ্য হয়ে ই তার সাথে যাত্রীবাহী রিকশা চালান।কিন্তু লকডাউন এর জেরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে ট্রেন-বাস। যাত্রীও মিলছে না। এদিকে স্কুল ও বন্ধ। দুই দিকেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে রোজগার। লকডাউন এর মধ্যে চরম সংকটে পড়েছেন দুলাল বাবু।
আক্ষেপের সঙ্গে জানালেন ১৫ বছর বয়স থেকেই রিকশা চালাচ্ছি। ৬৫ বছর হয়ে গেল এলাকায় তিনি রিকশা চালাচ্ছি। ব্যাংক থেকে ৫০০ টাকা লোন নিয়ে রিক্সাটি কিনে ছিলাম। সে সময় এলাকায় রিক্সা পাওয়া যেত না। মালদা সদর থেকে রিক্সা কিনে নিয়ে এসে ছিলাম। সেই রিক্সা মেরামত করতে করতে এখনো চলছে। রিক্সা চালিয়ে দুই ছেলে দুই মেয়েকে মানুষ করেছি। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। দুই ছেলে আলাদা থাকে। তিনি তার বৃদ্ধা স্ত্রী জেলেখা বিবি কে নিয়ে থাকেন। এই লক ডাউন এর মধ্যে নিত্যকার সংসার খরচ তার ও স্ত্রীর ওষুধের খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছি বলে জানালেন দুলাল বাবু। এখন আর কেউ রিকশা চড়তে চান না। খরচ কম তাই টোটো তে যাওয়া আসা করে এলাকার সবাই। পুরনো কয়েকজন এলাকার আছেন । তারাই মাঝেমাঝে তার রিকশায় চড়েন। লকডাউন এর আগে সারাদিন রিক্সা চালিয়ে ৫০ থেকে ৬০ টাকা রোজগার হত। এখন সেটাও বন্ধ।কিন্তু পেট তো কথা শোনে না তাই লকডাউন এর মধ্যেও কিছু রোজগার হবে এই আশাতে রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হচ্ছে। তবে এই বিগত দুই মাসে প্রায় দিনই খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিল।
একটা সময় হরিশ্চন্দ্রপুর এর সব জমিদার বাড়ির বাধা রিকশাচালক ছিলেন তিনি। হরিশ্চন্দ্রপুর এর জমিদার তথা রাজ্যসভার সাংসদ রাম প্রসন্ন রায় এলাকায় তার রিকশায় চড়ে যাওয়া আসা করতেন। এমনকি ট্রেন ধরতে গেলে শেখ দুলাল এর ডাক পড়তো রাম প্রসন্ন বাবুর জন্য।
স্থানীয় অনেক রাজনৈতিক নেতা ও তার রিক্সা তে চেপেছেন। প্রতিশ্রুতি ও মিলেছে ঢের। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি।
বহু কাঠখড় পুড়িয়ে বিপিএল কার্ড হয়েছে। বছর সাতেক আগে স্থানীয় পঞ্চায়েত মেম্বারের দৌলতে বার্ধক্য ভাতা ও হয়েছে। কিন্তু তা আর কতটুকু । মূল্যবৃদ্ধির বাজারে সংসার চালাতে পায়ে টানা রিকশা তাই একমাত্র ভরসা।
থাকার ঘরটি জরাজীর্ণ। সরকার থেকে যদি একটা আবাসের এর ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে খুব উপকার হয় বলে জানান তিনি
বেশ কয়েক বছর আগে রিকশা চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার জেরে পা ভেঙে ছিল।টানা কয়েক বছর বিছানায় শুয়ে ছিলেন। ক্ষমতা ছিলনা রিক্সা চালাবার। একটু সুস্থ হয় ভাঙ্গা পা নিয়ে আবার রিকশা চালাতে শুরু করেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা চিরঞ্জীব মিশ্র জানালেন শেখ দুলাল বহুদিন থেকে এলাকায় রিকশা চালাচ্ছেন। আমরা ছোটবেলা থেকেই ওনাকে রিক্সা চালাতে দেখছি। এখন অনেক বয়স হয়েছে। প্রশাসনের উচিত এদের পুনর্বাসন দেওয়া। হরিশ্চন্দ্রপুর পঞ্চায়েত সদস্য বাবন মল্লিক পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন |
শেখ দুলালের ছেলে ফিরোজ আলম জানালেন নিজের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, যতটুকু পারছি বাবার পাশে দাঁড়াচ্ছি |
হরিশ্চন্দ্রপুর ১ ব্লক বিডিও অনির্বাণ বসু রিক্সাচালক শেখ দুলাল এর পাশে দাঁড়াবেন, তার একটি ঘরের ব্যবস্থা করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন |