একজন পরিযায়ী শ্রমিকের আত্মকথা, করোনা সতর্কতায় আত্মত্যাগ

Social

মলয় দে নদীয়া :- কি এমন হলো ! প্রবাসে থাকা কালীন, যখন দু’বছর আগে প্রথম কাজে গিয়েছিলাম তখন সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত ফোন ধরতে পারতাম না, ২৫ টা ৩০ টা মিসকল হয়ে থাকতো মোবাইলে, আমার স্বদেশভূমির আত্মীয় পরিজন বন্ধু বান্ধব প্রতিবেশীদের। সন্ধ্যা বেলা বাসায় এসে কল ব্যাক করতাম সকলকে। তখন ছিল তাদের অভিমান! আর এখন আমার..

প্রবাসে থাকা কালীন শেষ মাসের মাইনেটা বাবার একাউন্টে পাঠানোর পর হাতে মাত্র ২০০০ টাকা। লকডাউনে প্রথম ১৫ দিনে দুবার খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দিলেও, তারপর দেখা মেলেনি কারোর। যেখানে সকলে মিলে বাসা ভাড়া করে থাকতাম, সেই বাড়ির মালিকও হিন্দি ভাষা ছেড়ে আঞ্চলিক ভাষায় কিসব বলাবলি করতো, ভাষায় না বুঝতে পারলেও ব্যবহারই পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলাম! বাড়ি ছাড়তে হবে। অনেকের উপদেশ অনুযায়ী উপদেশ দিয়েছিলো ভিডিও করে সাংবাদিকদের পাঠানো, জেলা শাসকের কাছে মেইল করে পাঠানো, নেতাদের ভিডিও কল করে দেখানো সবকিছু বিফলে যাওয়ার পর সরকারি আশা ছেড়ে ,পাঁচ বন্ধু মিলে বেরিয়ে পড়লাম পরিবারের সান্নিধ্যে পাওয়ার জন্য ।

পথের পাশে হাত পেতে কখনো, কখনও বা না বলেই লরির পেছনের ডালায়, কখনো কাঁচামালের সবজির ম্যাটাডোর চালককে অত্যন্ত শখের মোবাইলটা উপহার দিয়ে এসে পৌঁছেছি গ্রামে! কিন্তু একি? আমাদের গ্রামে ঢুকতে দেবেনা বলে যারা বিক্ষোভ করছে, তাদের মধ্যে দুএকজন আমার স্কুলে পড়া বন্ধু, ওই তো আমাদের গ্রামের মোড়ল হারুকাকা, বাবার খুব ভালো বন্ধু প্রতিদিন সকালে চা খেতে আসে আমাদের বাড়িতে উনিই তো গুজরাটে একটি কাজে আমাকে লাগিয়েছিলেন। উনার এক শ্যালক গ্রামের থেকে ছেলেদের নিয়ে গুজরাটের বিভিন্ন কারখানায় কাজ দেয়।

ভিড়ের মাঝখানে থেকে মা এসে বোঝালো, বড়রা তোদের ভালোর জন্যই স্কুলে থাকার বন্দোবস্ত করেছে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে তোদের শরীরের ১৪ দিন দেখতে দেখতে কেটে যাবে। মাকে বোঝাতে পারলাম না, ওই পরীক্ষা মানে থার্মাল স্ক্রীনিং তা দুবার হয়ে গেছে আসার সময়, কিন্তু এখানে যারা ভিড় করে প্রতিবাদ করছে তাদের অনেকেরই হয়নি, এমনকি মুখে মাস্কও নেই।

অগত্যা আর উপায় কি! স্কুল ঘরের সেই ছোট্ট ঘরটা এখন পাকা হয়েছে, লাইট ফ্যানও লাগানো হয়েছিল, কিন্তু রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে তা থেকে থেকে বঞ্চিত হয়েই, মশার কামড়ে রাত পার হলো। প্রতিদিন ভোর হয়, কমে ১৪ থেকে একটি দিন! বুড়ি মা একমাত্র দুপুরে খাবার দিয়ে যায় বন্ধ গেটের ওপার থেকে, গেটের নিচের ফাঁক থেকে শুধু মায়ের পা দুটি দেখতে পাই।

গতবার রথে আমার ছেলে হয়েছিল, দূর্গাপুজায় তিন দিনের জন্য বাড়িতে এসে দেখেছিলাম ওই একবার , ওর জন্য কেনা খেলনাগুলো মায়ের হাতে দিতে পারছিনা, ছোটবেলার কিছু না বুঝেই বায়না করার মতো বলে ফেললাম ও- মা কাল আসার সময় ছেলেটাকে নিয়ে আসবে? মুখ দেখতে পাচ্ছি না মায়ের, তবে বিষন্নকন্ঠে উত্তর পেলাম আর মাত্র 12 টা দিন বাবা! সবকিছু ভুলে থাকতে চেষ্টা কর।

এসে তো শুধু নদীয়া নয় সারা রাজ্যের কোয়ারেন্টাইন সেন্টারের বাইরে অপেক্ষারত অভিভাবকদের ভেতরে থাকা ঘরের ছেলেদের সার্বিক পরিস্থিতি। কেউ হেটে ফিরল ,কেউ খাবার পেল না এই দায় কার ?

Leave a Reply