ঘুরে আসতে পারেন উড়িষ্যার –গোপালপুর

Social

শুভব্রত ঠাকুর : চন্দ্রগিরি ও তপ্তপানি হয়ে আমাদের সেদিনের যাত্রা শেষ হল গোপালপুর সমুদ্রতটে এসে… ততক্ষনে সূর্যদেব পশ্চিম গোলার্ধের দেশগুলির রাতকে ফিকে করার প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত!

পরের দিন সকালে গোপালপুর থেকে বেরিয়ে আমরা চট করে ঘুরে নিলাম তারাতারিনি মন্দির ও রম্ভা।

তারাতারিনি মন্দির:

পুরান মতে পবিত্র একান্ন পীঠের মধ্যে অন্যতম প্রধান চারটি তন্ত্রপীঠ তথা শক্তিপীঠ হল গৌহাটির কামাখ্যা, কলকাতার কালীঘাট, পুরীর বিমলা এবং ব্রহ্মপুরের তারাতারিনি!
কথিত আছে এখানে নাকি দেবীর স্তনখন্ড পড়েছিল! ঋষিকূল্যা নদীর ধারে ৮০০ ফুট উঁচু কুমারী পাহাড়ের চূড়ায় তারাতারিনি মন্দিরের অবস্থান। পাহাড় চূড়ায় মন্দির দ্বারে পৌঁছানোর জন্য ৯৯৯ টি সিঁড়ি চড়তে হয়। অবশ্য ভক্তকুলের সুবিধার্থে বর্তমানে মন্দিরের প্রবেশদ্বার পর্যন্ত গাড়ি পৌঁছানোর রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। তাছাড়া রোপ-ওয়ে করেও মন্দির দ্বারে পৌঁছানোর ব্যবস্থা আছে।

কথিত আছে, দৈবশক্তি লাভের উদ্দেশে মহাভারতের ভগবান কৃষ্ণ ও যোদ্ধা অর্জুন নাকি এই মন্দিরে বসেই মাতা ভদ্রকালীর আরাধনা করেছিলেন! গর্ভগৃহে একটি সোনা ও একটি রুপোর বিগ্রহ স্থাপিত… একটি মাতা তারা ও অপরটি মাতা তারিনির।

কালীঘাট, তারাপীঠ, জগন্নাথ বা কামাখ্যা ভ্রমনের সাথে যে বিভীষিকা কিংবা বিরক্তি জড়িয়ে থাকে… তার কণা শতাংশও এখানে পেলাম না… না দোকানিদের টানাটানি, না পান্ডা অথবা সেবায়তদের ঝুলোঝুলি… ভক্তিভাবের সাথে আমার চিরকালীন চুলোচুলি থাকা সত্বেও… মনটা বেশ খুশি খুশি লাগল! তবে টানাহ্যাঁচড়ার সম্ভাবনা অবশ্য একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না.. কারন সারা মন্দির চত্ত্বর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য বিশেষ প্রজাতির ভক্তবৃন্দ সর্বক্ষণ তীক্ষ্ণ নজর রাখবে আপনার ওপর… তাঁরা যে আমাদেরই পূর্বজ… শাখামৃগ বাহিনী! সুতরাং একটু অন্যমনস্ক হলেই কপর্দক শূন্য হওয়ার প্রভূত সম্ভবনা!!

রম্ভা:  রম্ভা নামটার সাথে প্রথম পরিচয় ঘটে কালকূটের ‘নির্জন সৈকতে’ উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে… সেই কোন ছেলেবেলায়! যদিও লেখকের চোখে চেনা সেদিনের সেই রম্ভার সাথে এখনকার রম্ভার তুলনা টানা অনুচিত… তবু রম্ভা হল রম্ভাই! ব্রহ্মপুর থেকে ৪০ কিমি পশ্চিমে, বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম প্রাকৃতিক সামুদ্রিক হ্রদ চিল্কা’র প্রান্তদেশে অবস্থান এই মনোরম অঞ্চলের। পুরী, খুরদা ও গঞ্জাম জেলা জুড়ে বিস্তৃত ১১০০ বর্গ কিমি আয়তনের চিল্কা হ্রদের দক্ষিণ প্রান্ত জুড়ে রম্ভা। পাহাড় ও হ্রদের মেলবন্ধনে রম্ভার স্বর্গীয় শোভা অনস্বীকার্য! প্রবল বৃষ্টির মধ্যে স্পিড বোটে করে চিল্কা হ্রদের এ-প্রান্ত থেকে থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত চষে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা অনন্য! যদিও জলভীতির কারণে আমার বন্ধুপ্রবর তথা ভগ্নিপতিটিকে ‘ব্রেকফাস্ট আইল্যান্ড’, ‘বার্ডস আইল্যান্ড’, ‘হনিমুন আইল্যান্ড’, ‘সনকুদা আইল্যান্ড’, ‘ঘন্টাশিলা হিল (সিদ্ধা বাবা গুহা)’, ‘পিকনিক আইল্যান্ড’ বা ‘লাভার্স হিল’ দর্শন খুব একটা মুগ্ধ করতে পারলো বলে মনে হয় না! অতএব ফেরার পথে ‘তামপাড়া লেক’ ঘুরে গোপালপুর ফেরা।

কাছাকাছি অন্যতম আকর্ষণ ঋষিকূল্যা নদীর মোহনায় অলিভ রিডলে প্রজাতির কচ্ছপের প্রজনন স্থল। অবশ্য সেই হাজারে হাজারে কচ্ছপের দর্শন পেতে গেলে যেতে হবে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে! সুতরাং অসময়ে আমরা আর ওদিক মারানোর চেষ্টাও করলাম না!

গোপালপুর:

অশোকবাবুর নজর কলিঙ্গ সাম্রাজ্যের ওপর পরার আগে থেকে ও কলিঙ্গ রাজাদের রাজত্বের সময় থেকেই এই বন্দর শহরের উত্থান। এই বন্দর থেকেই জাহাজে করে দুর্মূল্য রেশম ও মুক্ত রফতানি করা হত জাভা ও সুমাত্রা প্রদেশে। পরবর্তীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসা ও রমরমা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও গোপালপুর বন্দরের বড় ভূমিকা ছিল! যদিও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর বার্মার সাথে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, এই বন্দর ইংরেজদের কাছে ক্রমশ তার গুরুত্ব হারায়! আশির দশক থেকে এই ছোট্ট জনপদ আবার পর্যটন স্থল হিসাবে জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ধ্বংসপ্রাপ্ত বন্দরের পুননির্মানের মাধ্যমে, বর্তমানে গোপালপুরের সেই হারানো গৌরব আবার ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে প্রশাসনিক স্তরে!

নিরিবিলিতে শান্তভাবে যারা সমুদ্রের সাথে ছুটিকে উপভোগ করতে চান… ‘গোপালপুর-অন-সি’ তাদের কে নিরাশ করবে না নিশ্চিন্ত!

কাছাকাছি ঘুরে দেখা যেতে পারে আর্যপল্লী বীচ, পতি-সোনপুর বীচ, ধ্বলেশ্বর বীচ ও ভৈরব মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী মন্দির প্রভৃতি। বন্দর আর লাইটহাউস দূর থেকে দেখেই আশ মেটাতে হবে, কারন এখন সেখানে জনগনের প্রবেশ নিষিদ্ধ!!

শেষদিনটা গোপালপুরে কাটিয়ে, পরদিন সকাল সকাল রওনা দিলাম ভুবনেশ্বর এর উদ্দেশে… ফাঁকতালে ভুলেই গিয়েছিলাম যে চারদিন হলো গৌরীদিদা বাড়ি ফিরে গেছেন… কিন্তু লক্ষ্মীপিসি ক’দিন পরে ফিরবেন মনস্থ করে থেকেই গেছেন। তাই কোলকাতা ফিরেই কাকার বাড়িতে গিয়ে ঝটফট দেখা সাক্ষাৎটা মিটিয়ে ফেলতে হবে.. কারন পিসি আবার ক্ষেপে গিয়ে বিমুখ হলে… মহা বিপদে পরে যেতে পারি! সুতরাং এবার আর নো স্লিপার কামরা… সোজা আধুনিক পুষ্পকরথ… ভুবনেশ্বর টু কোলকাতা…