মৃত্যু ও শূন্যতা / কলমে: বিকাশ চক্রবর্তী

Social

শ্মশানে গেছেন কখনো? এ এক অদ্ভুত জায়গা! যদি যান, তাহলে একমুহূর্তের জন্য হলেও খুঁজে পাবেন, জীবনের অন্য আরেক মানে!

গতকাল যে মানুষটি ভেবেছিল একটা গাড়ি কিনব, অথবা, সামনের রবিবার দুপুরে ইলিশ ভাপা দিয়ে ভাত খাবো, দেখবেন, সেই মানুষটাই আজকে শান্তভাবে শুয়ে আছেন। আজকে তাঁর আর কোনো চাহিদা নেই!!

মানুষটি পেছনে ফেলে রেখে এসেছেন, বিশাল বাড়ি অথবা ছোট্ট কুঁড়ে। ফেলে এসেছেন, লোভ, আশা, রাগ, হতাশা, তেজ আরও কত কিছু! আরও ফেলে এসেছেন, ব্যাঙ্কে দিস্তে দিস্তে কাগজ অথবা, মহাজনের কাছে দস্তখত করা কাগজ! অথচ, তার এখন এনিয়ে কোনো ভাবনা নেয়। যা হয় হোক! এই ভাবনা নিয়ে চুপ করে সব মজা দেখছেন।

এই মানুষটাই হয়তো গতকাল নিজেকে ঈশ্বর ভাবতেন; ভেবে, সবকিছু ভেঙ্গে দেওয়ার স্পর্ধা দেখাতেন। গলার সবটুকু জোর দিয়ে জানান দিতেন নিজের “আমিত্ব”কে। অথচ, আজ দেখুন কেমন চুপটি করে শুয়ে আছেন। সবাই এত কিছু বলছে, অথচ, দেখুন কারোর একটা কথারও প্রতিবাদ করছেন না তিঁনি।

এই মানুষটিই যখন জন্মেছিলেন, তখন তিনি ছিলেন একজন নিস্পাপ শিশু, গায়ে ছিল না সুতোর একটি টুকরোও!

আজ দেখুন, ঠিক সেই একই অবস্থায় আছেন! এক এক করে সোনার হার, আংটি খুলে নেওয়া হল, খুলে নেওয়া হলো, শেষ বস্ত্রটুকুও।

তারপর তাকে তুলে দেওয়া হল, কাঠের তৈরী এক শয্যায়। আপনি যেমন করে শুইয়ে দেবেন, ঠিক তেমন করেই শুয়ে থাকবেন, একটি বারের জন্যও বলবেন না, বিছানার নীচে তোষকটা কই গেল? বালিশটা পাচ্ছি না কেন!! ঠিক যেন, সেই জন্মমুহূর্ত! কোনো নালিশ নেই।। এমনকি শব্দ করে নিজেকে জানানোর আগ্রহটাও আর নেই।

একজন মানুষ, চোখ বুজে ঘুমোচ্ছেন, গায়ে তার একটি সুতোর টুকরোও নেয়, অথচ, মুখে লেগে আছে নিস্পাপ চাহনি!

ঠিক যেন জন্মের আগের মুহূর্তে, তখন আপনি জানতেনও না, সে কেমন দেখতে হবে! এখনো তাই! একটু পরেই সে, “নেই” হয়ে যাবে। আস্তে আস্তে চেনা শরীরটা অচেনা হতে হতে মিশে যাবে, “মাটি, জল, আগুন, হাওয়ায়”…

আপনি দেখছেন একজন মানুষ আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে পঞ্চভূতে! এর থেকে আশ্চর্য আর কী হতে পারে!

মানুষটি মিশে যাচ্ছেন আস্তে আস্তে, আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধু পরিজনেরা কত কথা বলছে! তাঁকে নিয়েই। অথচ আজ তিঁনি নিস্পাপ, শান্ত, কোমল! কোথায় গেল সেই রাগ? সেই আমিত্ব? সব ভুলে গিয়ে তিনি আজ মুক্তপ্রাণ!

কিন্তু গল্প এখানেই কি শেষ! একটু আশেপাশে তাকান। দূরে ওই মানুষটিকে দেখছেন? ওই যে লাল শার্ট পরে আছে যে। শোনার চেষ্টা করুন কি বলছেন উনি! শুনতে পাবেন, লাল শার্ট বিড়বিড় করছে,
– পাপ, বাপকেও ছাড়ে না, সেবার কটা টাকার জন্য কী অপমানটাই না করেছিলি, কী লাভটা হলো তোর এত টাকা থেকে।

তারপাশের জন মনে মনে বলছে,
-সেবার ঝগড়ার সময়, তুই আমাকে বাপ তুলে গালি দিয়েছিলি, এখন সেই দেমাকটা কোথায় গেল তোর?

পাশের বুড়োমানুষটা, সে চোখের জল মুছতে মুছতে বলছেন,
-বড্ড ভালো মানুষ ছিলো রে, সেবার আমার অসুখের সময় যা করেছিল …

বুড়োমানুষটার পাশের জনকে দেখেছেন, ওই যে সাদা ফতুয়া পরা। ভদ্রলোক পান চিবোচ্ছেন। উনি হলেন মানুষটির ভাই। পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে একসময় লাঠালাঠি হয়েছিল, এখন এ বাড়ির মাংস কষলে, পাঁচিল টপকে ও বাড়িতে যায় না, সেই ভাই ভাবছে,
– কাল মিউচুয়াল ফান্ড এর টাকাটা উঠবে। কোথাও একটু ঘুরতে গেলে ভালোই হয়। একটা মানালি ট্রিপ ম্যানেজ হয়ে যাবে।

অর্থাৎ, মানুষটি এখন নেই। শুধু রয়েছে তার টাকা পয়সা, বাড়ি-গাড়ি, আর তাকে ঘিরে কিছু হিসেব-নিকেষ। আর, সে শেষ সময়ে কী নিয়ে যাচ্ছে? নিয়ে যাচ্ছে সারাজীবনে মানুষের সাথে যা ব্যবহার করেছে, সেইগুলো! ভালো মন্দ সবকিছুই।

আপনার হয়তো সেই বিখ্যাত ছোটোগল্পটার কথা মনে পরে যাবে। যেখানে লেখক বলেছিলেন, একজন মানুষ কবরে সেই গুলোই নিয়ে যাবে, যেগুলো সে সারাজীবন ধরে তার চেনা মানুষগুলোর সাথে করেছে!!

আপনি যদি ভালো করে লক্ষ্য করেন, দেখবেন, একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে, মানুষটির ছেলে অথবা মেয়ে! সে ভাবছে, ইশ! কতদিন হলো, বাবা/মা’র সাথে ভালো করে কথা বলা হয় না। একটা ভালো ছবিও নেই, বাঁধাই করে রাখব।

অথচ দেখুন, সেই মেয়ে/ছেলেটির স্মার্টফোনে রয়েছে তার সন্তানের ছবি, প্রেমিকের ছবি, প্রেমিকার ছবি। রয়েছে, শেষবার ঘুরতে যাওয়ার কত্ত ছবি!

যে মানুষটি আজ হঠাৎ করে, ‘নেই’ হয়ে গেলেন, যদি তিনি বিবাহিত পুরুষ হন, এবং, তার স্ত্রী বেঁচে থাকেন, দেখবেন মানুষটির পায়ের কাছে রাখা আছে, ভেঙে ফেলা শাঁখা! একদিন এই মানুষটিকে পাবে বলেই এক তরুণী হৃদয়, কতো স্বপ্ন নিয়ে শাখা পরেছিল। সেই তরুণী আজ হয়তো প্রৌঢ়া এবং সেই একই মানুষের কারণেই, বিষাদ মনে, শাখা ভেঙেছেন, এবং, মানুষটির সাথেই পাঠিয়ে দিয়েছেন!! কি আশ্চর্য এই জীবন !

শ্মশানেই আপনি খুঁজে পাবেন কিছু নির্বিকার মানুষজনকে, যাদের এসব নাড়া দেয় না। তারা আপন মনে সুর ভাজেন, ছোটো খাটো কাজে আপনাকে সাহায্য করবেন। মৃত মানুষটির শেষ কাজে, এরা অনুঘটকের কাজ করেন। পুরোহিতকে তাড়া দেন। যিনি মুখাগ্নি করছেন, তাকে মনোবল জোগান,
-কেউ তো সারাজীবন থাকার জন্য আসে না।

আবার যদি মৃতের শরীরে, একটুকরো সুতো থেকে যায়, রেগে যান এরা।
-ও কী জন্মের সময় কিছু নিয়ে এসেছিল!
ঠিকই তো! যেভাবে এসেছি, সেভাবেই ফিরতে হবে আমাদের। সবাইকে।

এভাবেই খুব অল্প সময়ের মধ্যে, একজন, মানুষ থেকে লাশ, তারপর “নেই” হয়ে যায় ।

ছবি: ফেসবুক

Leave a Reply