শ্যামল কান্তি বিশ্বাস,নদীয়া : করোনো আবহে বর্তমানে সারা দেশজুড়ে চলছে লকডাউন । লকডাউনের ফলে শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে পেশাগত পরিবর্তন আবশ্যক হয়ে পড়েছে। বাস কন্টাকটার থেকে মাছ বিক্রেতা,টোটো চালক থেকে পনির বিক্রেতা, রাজমিস্ত্রি থেকে সবজি বিক্রেতা,দুধ বিক্রেতা থেকে মিষ্টি বিক্রেতা কিংবা বিউটিশিয়ান থেকে পারিবারিক মশলা বিক্রেতা, এরকম অজস্র উদাহরণ আজ চোখের সামনে।
পরিস্থিতি ক্রমশ উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে এবং নিশ্চিত ভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়তে চলেছে। রানাঘাট থেকে কৃষ্ণনগর ৯ নম্বর বাস রুটের অর্চনা বাসের কন্টাকটার সিতাংশু সাহা জানাচ্ছেন, দীর্ঘ ১৫ বছর যাবৎ পরিবহন পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত, এই পেশার উপার্জিত অর্থ দিয়ে সাংসারিক উন্নয়ন সহ বিবাহ এবং পরবর্তীতে সন্তান-সন্ততিদের পড়াশোনা, সবকিছুই হয়ে আসছিল কিন্তু হঠাৎ লকডাউনের ফলে গাড়ি বন্ধ। গাড়ি রাস্তায় না বেরোলে মালিক মাইনে দেবেন কি করে ? ফলে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সহ বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে নিয়ে জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার তাগিদে বাধ্য হয়েছি অন্য পেশায় যুক্ত হতে । এখন আমি পাড়ায় পাড়ায় সাইকেলে করে মাছ বিক্রি করি।
বাদকুল্লার খামার শিমুলিয়ার বাসিন্দা টোটো চালক উত্তম ঘোষ । তিনি জানালেন, আমাদের যৌথ পরিবার ছিল, বাবা কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত। মাঠে আমাদের নিজস্ব জমি বলতে চার বিঘা। আমরা ৪ ভাই ২ বোন। বোনেদের বিয়ের পর আমাদের সবাইকে বাবা পৃথক করে দিয়েছে। ৪ বিঘা জমির মধ্যে বোনেদের বিয়ের সময় প্রত্যেকের ক্ষেত্রে এক বিঘা করে জমি বিক্রি করতে হয়েছে, ফলে আমরা পৃথক হওয়ার পর মাঠের জমির ভাগ যা পেয়েছি, সে পরিমাণ জমি চাষ করে সংসার চালানো সম্ভব নয়। আমি বিবাহিত, স্ত্রী সহ দুই কন্যা সন্তান আমার। জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রথমে ফ্যানো এবং পরবর্তীতে টোটো গাড়ি চালাচ্ছিলাম, বেশ ভালোই আয় হচ্ছিল হঠাৎ লকডাউনে ছন্দপতন। মেয়েদের পড়াশোনার খরচ,সংসারের খরচ, বসে থাকলে চলবে কি করে? তাই বাধ্য হয়ে কিছু একটা করার তাগিদ থেকেই পাড়ায় পাড়ায় পনির বিক্রি করছি। বিক্রি খুব একটা হচ্ছেনা কিন্তু জীবন সংগ্রামে বাঁচতে তো হবে!
একই দশা বীরনগর বিলপাড়ার রাজমিস্ত্রি অনিমেষ হালদারের। তার আক্ষেপ, রাজমিস্ত্রি ছিলাম, ৮ জন শ্রমিক আমার অধীনে সহযোগী( জোগালে)হিসেবে কাজ করতো, এখন কাজ নেই,
সংসার চালাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। পাড়ার গলির মোড়ে সবজি নিয়ে বসেছি, বিক্রি তেমন নেই আবার অবিক্রিত সবজি বেশিদিন ঘরে রাখা যাচ্ছে না কিছু কিছু সবজি শুকিয়ে ওজন কমে যাচ্ছে, আবার কিছু কিছু সবজি পচে যাচ্ছে, ফলে লাভের থেকে লোকসান ই হচ্ছে বেশি।
চাপড়া নতুন পল্লীর ছানা বিক্রেতা সঞ্জয় ঘোষ জানালেন, স্বাভাবিক অবস্থা চলাকালীন এলাকার বিভিন্ন গ্ৰাম অর্থাৎ মাধবপুর, পটিয়া, ইছাপুর,আড়বান্দি প্রভৃতি গ্ৰাম থেকে দুধ এনে, সেই দুধ জ্বালিয়ে ছানা তৈরি করে সেই ছানা ট্রেণ মারফৎ নৈহাটি র প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠান, ‘ ‘শুভেচ্ছা’ তে বিক্রি করতাম, বাঁধা দোকান আমার। লকডাউনে সব বন্ধ কিন্তু পেট তো আর বন্ধ নেই,ফলে বাধ্য হয়েছি বিকল্প পথ বেছে নিতে। দুধ কেনার পরিমাণ অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছি, অল্পকিছু দুধ তুলে বাড়িতে ই জ্বালিয়ে ছানা তৈরি করে তা থেকে রসগোল্লা তৈরি করে কাছাকাছি পাড়ায় পাড়ায় বাড়িতে গিয়ে ফেরি করে বিক্রি করছি,কারন অন্য কাজ তো শিখিনি কিন্তু সংসার তো চালাতে হবে।
রানাঘাটের লেডিস বিউটি পার্লার “ড্রিমগার্ল” এর মালকিন রূপবহ্নি অনুপ্রিয়া জানালেন, লকডাউনে পার্লার বন্ধ, ফলে খরিদ্দার আসার প্রশ্ন ই নেই, ঘটনায় চরম আর্থিক সংকটে পড়েছেন অনুপ্রিয়া দেবী।রূপলাবণ্যে ভাটা পড়তে চলেছে,খাদ্যের অন্বেষণে এখন বাধ্য হয়ে কিছু একটা করার তাগিদ থেকেই বাড়িতে বাড়িতে ফেরি করে রান্নার মশলা ও খাদ্য সামগ্রী বিক্রি করছেন। পরিস্থিতি আজ মানুষকে কোন পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে।