কার্শিয়াং এর ছোট্ট গ্রাম সিটং, লাটপাঞ্চার ও মংপু /সুস্মিতা পান্ডে

Social

একেবারে প্রায় উড়ে গিয়ে জুড়ে বসলাম আমার ভাই ও মেয়ের কাছে।এমন কান্নাকাটি জুড়লো দুইজনে যে না গিয়ে আর পারা গেলনা,তাই ডাক্তার দেখিয়ে উড়ে গিয়ে ওদের সাথে এক হলাম শিলিগুড়িতে।

গন্তব্য কার্শিয়াং এর ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম -প্রথম দিন লাটপাঞ্চার,দ্বিতীয় দিন সিটংএবং তৃতীয় দিন মংপু।এক্কেবারে অপরিচিত অনীল দাদার সাথে রওনা দিলাম লাটপাঞ্চারের পথে।যে টুকু যা কথা তা ফোনেই হয়েছিল ওনার সাথে।রাস্তায় যেতে যেতেই দাদা আমাদের রুচি বুঝে যান তাই আদবার মতন বারবারই তিনি গাড়ি থামিয়ে আমাদের পর্যাপ্ত সময় দিয়েছেন ছবি তোলার জন্য।লাটপাঞ্চারে আমরা উঠি Chedhen Home Stay তে।দাদা ও বৌদির অসাধারন ব্যবহারকে সম্বল করে বেশ ভালোই কাটালাম।আমরা নিয়েছিলাম ব্যালকনি সহ ৪বেডের ঘর।এই রকম ছোট্ট একটি গ্রামের হোম স্টেতে সব সময় জল,গিজার, ইনভার্টার সব রয়েছে,ভাবা যায়!যেকোনো বড় হোটেল কে হার মানিয়ে দেবে এই হোম স্টে।যাই হোক কাজের কথায় আসি,আমি একটু পেটুক গোছের।মানে ওই খেতে ভালোবাসি আরকি,তাই খাওয়ার কথা আমার লেখায় থাকবেনা তা হতেই পারেনা।এক তো এতটা লম্বা রাস্তার ক্লান্তি তারওপর বহুদিন তেল, ঝাল, নুন, ভাত খাইনি।

যাওয়াটা যখন ফাইনাল হল তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে ,যাই হয়ে যাক আমি খাবোই। সারাদিন মুখে ওষুধ লাগাবো তবুও খাবো।চোখের সামনে ফুলকো ফুলকো লুচি দেখে তাই একটুও অপেক্ষা না করে চার জনেই হামলে পড়লাম লুচি ও তরকারির ওপর।পেট একটু ঠান্ডা হতেই চোখ আপনি বুজে আসতে লাগলো আমার।একে একে স্নান সেরে সকলেই একটু ঘুম দিলাম।এরমধ্যেই হাজির দুপুরের খাবার ও একটা কথা বলা হয়নি আমার কত্তাবাবুটিও পেটুক তাই আমাদের ঘুমোনোর সময়টুকু তিনি মন দিয়ে blome দাদার সাথে ওখানকার স্থানীয় খাবার দাবার নিয়ে জমিয়ে গল্প শুরু করেছিলেন যার ফল স্বরূপ দুপুরে আমাদের পাতে পড়লো ওখানকার স্থানীয় কিছু খাবার যেমন-করলার মতন একধরনের তেঁতোর সব্জি,আদার মতন গন্ধের একধরনের টক চাটনি,আমআদা নয়,দেখতে অনেকটা গোলমরিচের মতন।অসাধারন তার স্বাদ।আমি তো মনের আনন্দে খেয়ে যাচ্ছি কিন্তু কিছুই ঝাল লাগছেনা, পরে জানতে পারি রাজীব আগেই বৌদিকে সব রান্না ঝাল ছাড়া ও কম নুন দিয়ে রান্না করতে বলে দিয়েছিল।উফ!কি খেলাম।তেঁতো,স্যালাড, ডাল, বিনস ভাজি,মেশানো তরকারি,ডিমের কারি, পাঁপড় ও সেই চাটনি,জাস্ট জমে গেল খাওয়াটা।একটু পাহাড়ের সাথে সখ্যতা করতে করতেই blome দাদার ডাকাডাকি শুরু হয়ে গেল।সময় চলে গেলে যে আর তার দেখা পাবোনা যাকে দেখার জন্য এতদূর আসা।গুটিগুটি পায়ে পাহাড়ি রাস্তায় এগোতে শুরু করলাম।সকলেই আমার থেকে আগে আগে চলছিল,গাছের ডালপালা ডিঙিয়ে পাহাড়ি পথে চলা মোটেই সহজ কাজ নয় তবুও চলছিলাম।প্রায় মিনিট ৩০চলার পর যেখানে পৌঁছলাম সেখানে অনেক আগে থেকেই ক্যামেরা তৈরি করে কিছু ছবিবাবুরা বসেছিলেন।আমরাও একটা জায়গা দখল করে পাহাড়ের গাছপালার ওপর বসে পড়লাম।টুকিটাকি গল্প চলছিল যাকে দেখতে এসেছি তাকে নিয়ে।সকলেই বলাবলি করছিল গতকাল দেখা দেয়নি, আজ দেবেকিনা জানা নেই!আর দিলেও কতক্ষন যে তার অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে তার ঠিক নেই।এইসবের মাঝেই হটাৎ করে blome দাদা বললেন সকলকে চুপ করতে এবং উনি শুনতে বললেন একটি আওয়াজ!সেকি সাংঘাতিক আওয়াজ!অবশেষে দেখা মিলল প্রতীক্ষিত ধনেশ পাখির।যার ইংরেজি নাম হর্নবিল।উপরি পাওনা হয়ে জুটে গেল ছবিবাবুদের একটি দূরবীন।আহা !কি তার রূপ।যেমন রূপ তেমনই তার মহিমা।এবার আসা যাক ধনেশ পাখির জীবনচর্যার গল্পে আমরা যে সময় ইনার দেখা পেলাম তা ইনাদের ডিম দিয়ে বাচ্চা বড় করার সময় তাই আমরা পেলাম শুধুমাত্র পুরুষ ধনেশ পাখির দেখা।স্ত্রী ধনেশ পাখি এই পুরো সময়টা বাসার ভেতরে থাকে এবং বাসার মুখ থাকে মাটি দিয়ে বন্ধ করা।স্ত্রী পাখির ঠোঁটটিই শুধুমাত্র বাইরে বার করা থাকে,পুরুষ পাখি সারাদিন ধরে খাবার সংগ্রহ করে এবং গলার থলিতে জল নিয়ে আসে তার স্ত্রীর কাছে।এই আসার অপেক্ষাতেই স্ত্রী ধনেশ পাখি সহ আমরা বসেছিলাম।যখন সে আসছিল তার ডানা দিয়ে হাওয়া কাটার যা আওয়াজ তা সত্যিই ভয় পাওয়ার মতন।কত দায়িত্ব বলুন তো;ছয় মাস ধরে স্ত্রী পাখি ডিম দেবে বাচ্চা বড় করবে তবে বাসার বাইরে আসবে ততদিন পুরুষ পাখি তাকে পাহারা দেবে তার খাবার জোগাড় করবে।আচ্ছা এরা পরকীয়া করেনা??? মানে এতদিন শুধুমাত্র বউ এর ঠোঁট দেখতে পায় মুখটাও পায়না তাহলে এরা পরকীয়া করেনা কেন??আবার শুনলাম,পুরুষ পাখি যে দিকে উড়ে যায় স্ত্রী পাখি তার ঠোঁটটি সেই দিকেই করে রাখে পরেরবার যখন পুরুষ পাখি খাবার নিয়ে আসে তখন যদি সে যেদিক দিয়ে গিয়েছিল সেদিক দিয়ে না আসে তবে নাকি স্ত্রী পাখি খাবার নেয় না।কি আনুগত্য, কি বিশ্বাস তাই না??? নাকি এই ছয়মাস পুরুষ পাখিকে সামলে রাখা,যেন সে অন্য পাখির মায়ায় না পরে।এইবারে বুঝলেন এদের কেন পরকীয়া হয়না?? হাঃ হাঃ হাঃ মজা করছিলাম কিন্তু জানেন তো সত্যিই এই গল্প গুলো শুনলাম এদের নিয়ে যত শুনছিলাম ততই অবাক হচ্ছিলাম।কি অদ্ভুত না??? আরও একটা মজার কথা বলি এদের নাকি ঠোঁটের দাগ দেখে বয়স বোঝা যায়।যার যত বয়স তার ঠোঁটে ততগুলো দাগ।আমরা যাকে দেখি তার ছয় বছর বয়স,ওজন প্রায় চার পাঁচ কেজির কাছাকাছি হবে।প্রায় মিনিট ১০ সময় দিলেন তিনি আমাদের তাকে দেখার জন্য ও ছবি তোলার জন্য।উড়ে যাওয়ার সময়ও সেই একই রকমই আওয়াজ।এইবারে গুটিগুটি পায়ে হোম স্টেট র পথ ধরলাম।রাস্তায় আসার সময় blome দাদা আমাদের অনেক নতুন নতুন গাছ ও আরও নানান ধরনের পাখি দেখালেন।এইসব করতে করতে কখন যে ঘরের দরজায় পৌঁছে গেলাম বুঝতেই পারলাম না।ঘরে ঢুকতেই বিস্কুট সহযোগে চা চলে আসলো।চা নামক জিনিসটির প্রতি আমার ভীষণই দুর্বলতা,খুব কাছের যারা তারা আমার চা প্রীতির কথা বেশ ভালোই জানেন।চিনি ছাড়া ধোঁয়া ওঠা লাল চা।আহা ! অসাধারন তার গন্ধ।একটিতে আমার মন ভরলো না এই দিকে blome দাদা ও বৌদি বুঝে গিয়েছেন যে আমি চা পাগল তাই রাতের খাবারের আগে পর্যন্ত ঘন ঘনই আসতে থাকলো আমার জন্য চা।এই চা homemade ভীষণ সুন্দরএর গন্ধ ও স্বাদ চা খেতে খেতেই blome দাদার সাথে আমাদের হোম স্টে র সামনের পাহাড় গুলো নিয়ে গল্প হচ্ছিল তার থেকেই জানতে পারি যে ঘরের সামনের পাহাড়টা পুরোটাই কমলালেবুর বাগান। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের নিয়ন্ত্রণাধীন ওই পাহাড় আর সেখানে নাকি মাঝে মাঝেই হাতি ও চিতাবাঘ আসে।সামনের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে আর তার সাথে সাথে বাড়তে থাকে পাখির আওয়াজ।নানান ধরনের আওয়াজ,এইসব আওয়াজের মাঝেই কখন যে ৮টা বেজে যায় আমরা খেয়ালই করিনি।সকাল সকাল রুটি,ভিন্ডি ভাজি,ডাল ও লাজবাব স্বাদের চিকেন খেয়ে আমরা শুয়ে পরি।হ্যাঁ আর.. একটা কথা এইখানে কোনো মোবাইলেই কিন্তু কোনো রকম নেটওয়ার্ক পাবেন না।তাই আমি ভীষণই আনন্দে ছিলাম,কারোর হাতেই আর মোবাইল নেই তাই গল্প গুলো বেশ ভালোই জমে উঠছিল।ফোনে সিগনাল না থাকার জন্য আমার ভাই বললো এইটা বনবাসের মতন লাগছে।

আমিতো বেশ আনন্দেই ছিলাম।পরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই আমি আর রাজীব হাঁটতে চলে যাই,হাঁটতে হাঁটতে সেই সামনের পাহাড়ে যাওয়ার পথ ধরে ফেলি।অনেকটা যাওয়ায় পর হঠাৎ করেই কোথা থেকে কিছুটা মেঘ এসে আমাদের ঘিরে ফেলে।মেঘ আমার বড়ই ভালোলাগার জিনিস তাই আমি আনন্দে লাফালাফি শুরু করে দিই।ঘন মেঘের খোঁজে জঙ্গলের পথ ধরে দুই জনে এগিয়ে যেতে থাকি একসময় এক হাত দূরের কিছুও আর দেখতে পাচ্ছিলামনা।হঠাৎই কেমন যেন ভয় করতে লাগলো তাই পেছন ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম।যাদের জন্য এই ঘুরতে আসা তারা দুই জনে তো ঘরে ঘুমোচ্ছে আমরা কোন দিকে এসেছি কিছুই জানে না,তাই ফিরতি পথ ধরাটাই ঠিক কাজ বলে তখন মনে হল।ঘরে ফিরে চটপট জলখাবার শেষ করেই আমরা রওনা হয়ে গেলাম কারন আজ আমাদের অনেক গুলো জায়গা ঘোরার কথা।প্রথমেই গেলাম আহলদারা ভিউ পয়েন্ট।আমরা যখন ওখানে পৌঁছই তখন চতুর্দিক মেঘে ঢেকে ছিল, সকলেরই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল।তবে ভাই আর গুল্লু ছিল নিজের মেজাজে।ওই মেঘের মধ্যেও ওদের ছবি তোলায় কোনো বিরাম ছিলনা আর রাজীব ছিল অন্য ধান্দায়।এক সময় নাকি মেঘ কাটবে আর ও দূরের পাহাড় গুলো দেখবে।প্রায় মিনিট ৩০পরে সত্যিই মেঘ কাটে ।সম্পূর্ন দেখা না গেলেও যা পেলাম তাও কিছু কম নয়।এ যাত্রায় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা হলনা তো কি হয়েছে পরের বার নিশ্চই হবে এই আশা নিয়ে আমরা নামথিং পোখড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।ভীষণই সুন্দর একটি লেক,চতুর্দিক পাইন গাছ দিয়ে ঘেরা।আমরা জল পাইনি তবে যা প্রাকৃতিক দৃশ্য তাতে জল না পেলেও মন ভরে যায়।মাঝে মাঝেই মেঘ এসে চতুর্দিক ঢেকে দিচ্ছিল।ছবি পর্ব সমাপ্ত করে আমরা গেলাম ৪০০বছর পুরোনো মাটির তৈরী বৌদ্ধ গুম্ফায়।এত বছর আগে তৈরী হলেও তার সৌন্দর্য্য অতুলনীয়।অনীল দাদার প্রণাম দেখে আমার কন্যাও হুবহু তা করে ফেললো।এই দুই দিনে অনীল দা আমাদের অনেকটাই কাছের মানুষ হয়ে উঠেছেন এবং আমাদের গাইডের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।আমাদের প্রকৃতি প্রেম দেখে এবং আমাদের গাছপালা চেনার আগ্রহ দেখে উনি আমার কন্যাকে গাছ চেনাতে লাগলেন এবং তার উপকারিতাও বলতে লাগলেন।সকলেই বেশ ভালো উপভোগ করছিলাম বিষয়টা। বিরাট বড় একটা মেঘ চলে আসার জন্য বাধ্য হয়ে সকলে গাড়িতে উঠে বসলাম ঠিক তখনই দুই দিন পরে আমাদের প্রথম ফোন বেজে উঠলো মেঘবিতান হোমস্টের সমীর বাবুর ফোন আসলে ওইদিন সকাল সকালই আমাদের ওখানে ঢোকার কথা ছিল,কিন্তু ওই যে কমলালেবুর বাগান খুঁজতে গিয়েই তো আমাদের যত দেরি হয়ে গেল।ফোনটা শুনেই আমার কন্যার মুখ হাঁড়ি,কারন অনীল কাকু তাকে পাক্কা প্রমিস করেছিল মোমো খাওয়াবে বলে কিন্তু হোমস্টেতে চলে গেলে তো তার আর ওই স্পেশাল মোমোটা খাওয়া হবেনা।মামা-ভাগ্নির আলোচনা শুনে অনীলদা প্রথমে তাকে মোমো খাওয়াতেই নিয়ে গে।সকলেরই কম বেশি খিদে পেয়েছিল তাই প্রত্যেকেই মোমো খেলাম।এইদিকে সমীর বাবু বারবার ফোন করছেন,ভাবছেন আমরা বুঝি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। খাওয়া শেষ করে আমরা চা বাগানের পথ ধরলাম; মেঘবিতান যাওয়ার জন্য।চা বাগানের মাঝে পাহাড়ের ওপর মেঘবিতান।পৌঁছতেই মেঘবিতানের সকলে আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এগিয়ে আসলো। আমাদের দেরির কারণ শুনে সমীর বাবু হেসে ফেললেন গুল্লুকে বললেন তুমিতো এখানেই মোমো খেতে পারতে।দুপুরের খাবার সময় পার হয়ে গিয়েছিল তাই উনি আমাদের বললেন আপনারা একটু ফ্রেস হয়ে নিন এক্ষুনি গরম ভাত হয়ে যাবে আপনারা খেয়ে নেবেন।তাই হল,গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত,ডাল, স্যালাড,বিনস ভাজি,মাছের ঝোল,পাঁপড় ও আঁচার দিয়ে মেঘবিতানের বারান্দায় বসে মেঘ পাহাড়ের লুকোচুরির খেলা দেখতে দেখতে খাওয়াটা বেশ ভালোই জমে গেল।আমাদের কপাল খারাপ তাই না-হলে এখানে বসে বসেই কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মেলে ।কি আর করবো কপাল যখন খারাপ তখন তো আর কিছু বলার নেই।খাওয়ার পরই আমি আর আমার কন্যা চলে গেলাম চা পাতা তুলতে বাগানের ভেতর একটু মজা করেই নেমে আসতে বাধ্য হলাম বৃষ্টির জন্য।বিকেলে নিচের পথে হাঁটা লাগালাম; কিছুক্ষনের মধ্যেই এমন মেঘ চলে আসলো যে আর কিছুই দেখতে পাওয়া যাচ্ছিলনা।অগত্যা ঘরে ফিরে আসা গল্প ,খুনসুটি ,ঝগড়া এইসব করতে করতেই রাতের খাবার হাজির।খেয়েদেয়ে জমিয়ে ঘুম দিলাম,ঠাণ্ডাটাও বেশ ভালোই ছিল।তাই আর বেশি রাত্রি করার সাহস কেও দেখাইনি এই ঘুমের ফাঁকে মেঘবিতান সম্পর্কে কয়েকটা কথা বলে রাখি…Upper sittong এর মেঘবিতানের সমীর বাবু মানুষটি একেবারে অন্যরকম।একা দুর্গ সামলানোর মতন উনি মেঘবিতানকে সামলে চলেছেন।চতুর্দিকে সব নেপালিদের মাঝে উনি একা বাঙালি কিন্তু উনি এক কথায় ওখানে পর্যটকদের মুসকিল আসান।ওনার সহকারীরাও বেশ ভালো মানুষ সদাহাস্য মুখ নিয়ে বিরক্তি ছাড়া সকলের আবদার মিটিয়ে যাচ্ছেন।এই এলাকায় এমন কেও নেই যে সমীর বাবু কে চেনেননা।আপনার যেকোনো সমস্যার সমাধান সমীর বাবুর কাছে আছে।রাত্রে তাঁবু নিয়ে পাহাড়ের মাথায় থাকতে চান??শীতের হওয়া গায়ে মেখে বনফায়ার করতে চান??যে কোনো সমস্যা শুধু জানান সমীর বাবুকে।আমাদের উনি অনেক পরামর্শ দিয়েছেন।এবার বেড়ানোর কথায় আসা যাক।ভোরবেলা সাড়ে ৪টা নাগাদ ঘুম ভাঙতেই দেখি মেঘ উধাও!তবে সূর্যিমামার দেখা নেই।সকলে ঘুমোচ্ছে কিন্তু আমি আর থাকতে পারলামনা।চা বাগানের ওপরের পথে হাঁটা শুরু করলাম ;কিছুদূর যাওয়ার পর শুনতে পাই ভাইদের আওয়াজ।আমায় বেরোতে দেখে ওরাও আর ঘরে টিকতে পারেনি,হাঁটতে হাঁটতে আমরা পাহাড়ি এক দাদাকে নিয়ে দূরবীনদাঁড়ায় পৌঁছে যাই।সূর্যিমামা কৃপা করলে এখান থেকে তিস্তা,কাঞ্চনজঙ্ঘা সব নাকি দারুন দেখায়।অনেকেই এখানে আসেন কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় দেখার জন্য।কপাল মন্দ তাই জুটেও জুটলো না। যদিও আমরা বর্ষার পাহাড় দেখবো বলেই এই সময় এই জায়গাটায় এসেছি আমার এবং রাজীবের বর্ষার পাহাড় ভীষণই প্রিয়। মেয়েটিও হয়েছে আমাদের মতনই আর ভাইতো বরাবরই আমার পিছু নেয়। ঘরে ফিরে সমীর বাবুকে সব বলতেই তিনি আমাদের বললেন তবে আপনার আজ আর অর্কিড গার্ডেন না গিয়ে লেপচা ফলস যান ;আপনারা যখন দূরবিনে উঠতে পেরেছেন লেপচা ফলসে খুব সহজেই পারবেন ।অনীল দাদা আসতেই তাকে বলে দিলেন লেপচা ফলসের কথা আমরাও জলখাবার খেয়েই রওনা হয়ে গেলাম।অনেকটা রাস্তা পার হয়ে আমরা পৌঁছলাম লেপচা ফলস মানে লেপচা ফলস্ এ গাড়ি রাখার জায়গায়।এরপর শুরু হল পাহাড়ের চড়াই উতরাই ভেঙে হাঁটা,প্রায় ৪০ মিনিটের কষ্টকর হাঁটার শেষে পৌঁছলাম লেপচা ফলস।যারা এডভেঞ্চার ভালোবাসেন তারা যেতেই পারেন এই জায়গায় আমাদের বেশ ভালোই লাগলো জায়গাটা।পুরো সিটং জুড়েই কমলালেবুর বাগান,শীতের সময় গেলে হাতের নাগালেই পাবেন কমলালেবু।রাস্তার দুইপাশে শুধুই কমলালেবু আর সিঙ্কনা গাছ।সত্যিই মন জুড়িয়ে যাওয়া দৃশ্য।এরপরের গন্তব্য রেইনখোলা শান্ত পাহাড়ি নদী তার উপর স্টিলের তৈরি ব্রিজ।এই জায়গার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য সত্যিই ভীষণ সুন্দর।অল্প একটু খাওয়া দাওয়া করেই আমরা রওনা হয়ে গেলাম মংপুর উদ্দেশ্যে।প্রখ্যাত লেখিকা মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়ি; যে বাড়িতে রবিঠাকুর বহুবার এসেছেন।এই বাড়িতে বসে তিনি অনেক গান ও কবিতা লেখেন আজও ওনার ব্যবহার করা আসবাব সযত্নে এই বাড়িতে রাখা রয়েছে।এই বাড়িতে আসার পর থেকেই অন্যরকম একটা অনুভুতি হচ্ছিল,কিছুতেই মন চাইছিল না বাড়িটা থেকে আসতে। সত্যি!রবিঠাকুর বাঙালির ভীষন দুর্বলতার জায়গা।এতক্ষন প্রকৃতির প্রেমে পাগল ছিলাম আর এখন রবি ঠাকুরের মায়ার বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে গেলাম।এই বাড়িটি সিঙ্কনা প্ল্যান্টের নিয়ন্ত্রণে তারাই রক্ষনাবেক্ষন করেন।বাড়ির ঠিক পাশেই সিঙ্কনা প্ল্যান্ট ভেতরে যাওয়া যাবেনা তবে রাস্তায় আসার সময় প্ল্যান্টের অনেকটাই দেখা যায়।সুন্দর পরিবেশ এইসব দেখতে দেখতেই অনেকটা সময় কেটে যায়।শেষমেশ ঘড়ির কাঁটার তাগাদায় বাড়ির বারান্দা থেকে উঠতে বাধ্য হলাম।এবার বাড়ির পথ ধরার পালা পথে যদিও অনেকবারই দাঁড়াতে হল কারন আমার কন্যা এখানে এসে থেকে নানান ধরণের গাছের পাতা,ছাল ও ফুল সংগ্রহ করে চলেছে।অনীল দাদাও হয়েছে এই কর্মে ওর সাথী।তাই ওনার জানা ভেষজ গাছ গুলি উনি রাস্তাতে যেখানেই দেখেছেন দাঁড়িয়ে তা গুল্লুকে এনে দিয়েছেন।এতদিন পর্যন্ত যত জায়গায় ঘুরতে গিয়েছি,সকল ড্রাইভার দাদাদের ভীষণই ভালো পেয়েছি।বলতে পারেন ড্রাইভার ভাগ্যটি আমাদের বেশ ভালোই।এনজেপি স্টেশনে যখন অনীল দাদা আমাদের নামিয়ে চলে যাচ্ছেন তখন আমাদের সকলেরই ভীষন মন খারাপ কিন্তু কিছু করার নেই।এইভাবেই কিছু অপরিচিত মানুষের সাথে মানুষের এক সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে যা চিরকাল মনের মনিকোঠায় তোলা থাকে।

ধন্যবাদ জানাই সমীর বাবুকে মেঘবিতানে এত সুন্দর ব্যবস্থা রাখার জন্য এবং লাটপাঞ্চারে এত ভালো ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য।অনেক ধন্যবাদ অনীল দাদাকে।
আপনাদের এত সুন্দর ব্যবহারই আমাদের মতন পাহাড় পাগলদের বারবার পাহাড়ে টেনে নিয়ে যায়।আপনারা এই রকমই থাকবেন ও ভালো থাকবেন।
আপনাদের জন্য কিছু তথ্য দিয়ে রাখলাম:::

লাটপাঞ্চার :থাকা খাওয়া নিয়ে জন প্রতি ১০০০ টাকা,যোগাযোগ নম্বর–6295047407(blome দাদা)

সিটং:যোগাযোগ নম্বর–9333473745(Samir Dhali)…আমার থেকে বেশী ভালো সমীর বাবুই সবটা বলতে পারবেন তাই ওনার সাথে কথা বলাই সবথেকে ভালো।
গাড়ির জন্য: 7432998465(অনীল দাদা).