মলয় দে নদীয়া:-বারবার যুদ্ধে নাজেহাল মধ্য আফ্রিকার কঙ্গো দেশ। নিপুন দক্ষতায় শান্তিরক্ষার দায়িত্ব সামলে সকলকে অবাক করে দিয়ে ছিনিয়ে নিলেন রাষ্ট্রসঙ্ঘ থেকে পুরস্কার। বুদ্ধি ও কৌশলতার জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘ থেকে সম্মানিত হলেন নদীয়ার কৃষ্ণগঞ্জের শিবনিবাসের অরুনাভ মুখোপাধ্যায়। প্রায় এক বছর ধরে সেই দেশের বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করে চলেছেন । সুরক্ষা দিতে গিয়ে এসেছে বারবার বাধা । সেই বাঁধাকে দূর করতে প্রয়োজনে বন্দুক হাতে লড়াইও করতে হয়েছে অরুনাভকে। বঙ্গ সন্তানের নিপুণ পারদর্শিতার জন্য পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে কঙ্গোর জঙ্গী গোষ্ঠী। রাষ্ট্রসঙ্ঘের শান্তি রক্ষা মিশনের বিশেষ দলের সঙ্গে গিয়েছিলেন অরুণাভ। কঙ্গোর সঙ্কটে মানবতাকে রক্ষার গুরুদায়িত্ব পরেছিল তার নেতৃত্বাধীন বাহিনীর কাঁধে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি পারদর্শিতা দেখিয়ে শান্তির ধ্বজা তুলে দিয়েছেন। এই পারদর্শিতার জন্য ও সফলভাবে দলকে পরিচালনা করবার জন্য বাঙালি যুবকের হাতে উঠেছে পদক ।তার সাফল্যকে কুর্নিশ জানিয়েছে রাষ্ট্রসংঘ। ‘পিস কিপিং’ মেডেল দেওয়া হয়েছে অরুনাভবাবুকে। তাঁকে নিয়ে গর্বিত নদীয়া জেলাবাসী।
কঙ্গোয় কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে হাড় হিম করা পরিশ্রম করে যাচ্ছেন অরুণাভ। ফোনে আলাপচারিতায় অরুনাভ জানায়, ‘আমরা যৌথভাবে কাজ করছি। কঙ্গো দেশের সর্বস্তরের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। তাঁদের কাছে সামান্য হলেও মানবাধিকারের বিষয়গুলি পৌঁছে দিতে আমরা সক্ষম হয়েছি।। যার মধ্যে অন্যতম হল খাদ্য ও ওষুধ। একবছর ধরে এই কাজ করে চলেছেন। এই মহৎ কাজের জন্যই অরুনাভ বাবুকে দেওয়া হয়েছ পিস কিপিং মেডেল । সম্মান পেয়ে আনন্দিত ও গর্বিত বলে জানালেন অরুণাভবাবু ।
অরুণাভ বাবু বিএসএফের হেড কনস্টেবল পদে রয়েছেন । বাড়ি নদীয়া জেলার কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকের শিব নিবাসের এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শিবমন্দিরের সামনে। বাবা অমিতাভ মুখোপাধ্যায় সেনাবাহিনীতে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন । সেনাবাহিনী থেকে কাজ ছেড়ে দিয়ে তিনি বিএসএফের ইন্সপেক্টর পদে কাজে যোগদান করেন। বর্তমানে বিএসএফের অবসরপ্রাপ্ত ইন্সপেক্টর।
অরুণাভর পোস্টিং ছিল দিল্লিতে। ২০২৪ সালের মে মাসে রাষ্ট্রসঙ্ঘের তরফে ভারতের ২১ জন মহিলা সহ ১৬০ জন্য বিএসএফ জওয়ানকে কঙ্গো দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে সেই দলেই রয়েছেন অরুণাভ। শান্তিরক্ষা মিশনের লক্ষ্যই হল, কঙ্গো সরকারকে সহায়তা প্রদান করে সেদেশের নাগরিকদের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা। পাশাপাশি একজন মানবিক কর্মী হিসেবে সেখানকার মানুষের জীবন রক্ষা করা।
প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাস জড়িয়ে কঙ্গো দেশের সঙ্গে। মূলত আদি জনজাতির বাস। তাদের মধ্যে গিয়ে কাজ করে সাধারণ মানুষদের সাথে মিলেমিশে থাকা, অন্যদিকে জঙ্গি সংগঠনকে কঠোর হাতে দমন করা ও এলাকায় শান্তি ফেরানোর মহৎ কাজের জন্য
‘পিস কিপিং’ মেডেল পায় অরুনাভ ।
১৯৬০ সাল ফরাসিদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে দেশটি। তার পরও একাধিক বৈদেশিক শক্তির আগ্রাসনের শিকার হয়েছে কঙ্গো। তার উপর দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়েছে। সেদেশের সরকারের সঙ্গে এম-২৩ জঙ্গিগোষ্ঠীর লাগাতার সংঘর্ষ হয়েছে। এখনও হয়। সবমিলিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে সে দেশের মানবতা। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি সকল ক্ষেত্রেই বেহাল অবস্থা। এর নেপথ্য কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহল মনে করে, কঙ্গোর ভূগর্ভে রয়েছ বহুমূল্যবান খনিজ পদার্থ। সেগুলি দখলে নজর রয়েছে পশ্চিম দুনিয়ার। তারাই নানা দিক দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে অশান্তি পাকিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে কঙ্গোর পাশেই দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘ।
অরুণাভ ও তাঁর দল কঙ্গোয় গিয়ে প্রথমে উঠেছিল শহর গোমাতে। সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে বেনি শহরের চলে যান তাঁরা। এরই মধ্যে জঙ্গিগোষ্ঠী এম-২৩ আক্রমণ করে গোমা শহরে। সেখানকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ধংস করে দেয়। প্রায় ৭ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন পার্শ্ববর্তী শহর বেনি থেকে অরুণাভরা ছুটে গিয়েছিলেন বিশ্বস্ত গোমায়। সেখানকার মানুষদের কাছে খাবার, ওষুধ, থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে দেন। ভয়ঙ্কর সেই জঙ্গিগোষ্ঠী একবার বেনি শহর দখল করার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করে। কিন্তু বাঙালি সন্তানের নেতৃত্বে দিল্লি থেকে যাওয়া পুরো দলটি কড়া হাতে মোকাবিলা করে। জঙ্গিদের বোকাবু শহরেই আটকে দেন তাঁরা। এখনও সেই বেনি শহরকে আগলে রেখেছেন অরুণাভরা।এবার আসা যাক এই অরুনাভ সম্পর্কে। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র হিসাবে পরিচিত । বাবা সেনাবাহিনী থেকে কাজ করে বাড়ি ফেরার পর ছেলেরও মনে যে ধরেছিল সে সেনাবাহিনীর যোগদান করবে এবং দেশের সেবা করবে । পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধুলায় ছিল পারদর্শী । ডিগ্রি কোর্স পাস করার পর স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকতা চাকরি পান । কিছুদিন কাজ করার পর তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিএসএফ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন । এখনো তিনি যখন বাড়ি আসেন পাড়া-প্রতিবেশীরা তাকে নিয়ে হৈই হুল্লোড় করে । যে কদিন বাড়িতে থাকে সে কদিন ছেলেপেলেদের সাথে খেলাধুলা ,শরীরচর্চা করেন। স্থানীয় ছোট ছোট শিশুদের কাছে তিনি খুব প্রিয় মানুষ । কারণ শিশুদের দেখলে তিনি যেমন আদর করে কোলে তুলে নেন, তেমনি শিশুরাও তাকে পেলে আনন্দে ,খুশিতে ভরে ওঠে।
স্থানীয়রা অরুণাভর পদক পাওয়ার খবরে খুশি । বঙ্গসন্তানের এই কৃতিত্বকে সবাই কুর্নিশ জানাচ্ছে । আমরাও তার বুদ্ধি ও নিপুন দক্ষতার জন্য কুর্নিশ জানাই । তিনি শুধু কঙ্গো দেশে পুরস্কার পাননি তিনি আমাদের দেশ ভারত বর্ষকে সম্মানিত করেছেন তার বুদ্ধি ও দক্ষতাকে দিয়ে ।