মলয় দে নদীয়া:-নদিয়া জেলার কৃষ্ণগঞ্জ থানার অধীনে বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা মাটিয়ারী গ্রামটিতে নদীয়ার রাজবংশের প্রথম পুরুষ ভাবানন্দ মজুমদার তার রাজধানী স্থাপন করেছিলেন । বসবাস সূত্রে ভবানন্দ ছিলেন জমিদার পরিবারের সন্তান । তার রাজত্বকাল ছিল ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। যদিও এই রাজবংশের শ্রেষ্ঠ পুরুষ ছিলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় বাহাদুর ।
বানপুর মাটিয়ারী বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ও বিশিষ্ট কবি সাহিত্যিক মতাদর্শ তাপস কুমার মিত্রের কাছ থেকে জানতে পারা যায় ভবানন্দের রাজত্বকালে একজন পারস্য দেশীয় সুফি ধর্ম প্রচারের জন্য এই মাটিয়ারীতে আসেন । তার আসল নাম ছিল ফকির আবদুল্লাহ । তিনি মাটিয়ারী গ্রামে পীর হযরত শাহ মুলুকে গডস্ (মল্লিক গস্ ) নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন । কথাটির অর্থ হল ফকিরের বাদশা । অবশ্য বাবা বুড়ো সাহেব নামেই তিনি অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেন । তাকে মাটিয়ারী গ্রামে থাকার জন্য ভবানন্দ মজুমদার অনুরোধ করেছিলেন । তার বসবাসের জন্য গৃহ নির্মাণ করে দেন । এবং মৃত্যুর পর এই বাসস্থানে মাজার তৈরি করেন । এই মাজারি বুড়ো সাহেবের দরগা নামে পরিচিত লাভ করে । জনশ্রুতি আছে ঐশ্বরিক গুনসম্পন্ন বাবা বুড়ো সাহেবের আগমন এবং তিরোধান এর দুটি দিনই ছিল ৭ই আষার অম্বুবাচী তিথি । তার তিরোধানের পর ৭ই আষার অম্বুবাচী পূর্ণ তিথিতে এই অঞ্চলে বাবা বুড়ো সাহেবের দরগা কে কেন্দ্র করে দরগা এবং দরগার সংলগ্ন বাজার অঞ্চলে আকর্ষণীয় মেলা বসে । গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে মেলা উপলক্ষে আত্মীয়-স্বজনের আগমন ঘটে । দরগা প্রান্তে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে মানুষে মানুষে মেল বন্ধন হয় । কবির ভাষায় “আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে. তাই হেরি তায় সকল খানে॥” ইতিহাস থেকে জানা যায় ১৬ শতকে পারস্যের ইস্পাহান শহরে আব্দুল্লার জন্ম । বড় হয়ে তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন এবং পীর পয়গম্বর রূপে দেশে-বিদেশে ভ্রমণ করেন । ভবানন্দ মজুমদার মাটিয়ারীতে রাজধানী স্থাপনের কিছুকাল পড়ে পীর আব্দুল্লা মাটিয়ারীতে আসেন সঙ্গে আনেন আরো দুই শিষ্যকে । তার অলৌকিক ক্ষমতা ,উদার, শান্ত মনোভাব দেখে ভবানন্দ মজুমদারের মনে ভক্তি জন্মায় । পাশাপাশি এই মাটিয়ারিতে তখন প্রচুর মানুষ কঠিন জরা ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় । ভবানন্দ মজুমদার আব্দুল্লাহ র কাছে তার প্রজাদের মঙ্গল এবং অসুখ-বিসুখ থেকে প্রজাদের বাঁচানোর জন্য অনুরোধ করেন । ভবানন্দ মজুমদারের কথায় পীর বাবা আব্দুল্লাহ স্থানীয় বাসিন্দাদের বিভিন্ন রকম গাছ গাছড়া দিয়ে কবিরাজি মতে চিকিৎসা করেন । আব্দুল্লাহ র হাতের যাদুতে তাদের রোগ মুক্ত হয় । এরপর আব্দুল্লাহ মাটিয়ারী ছেরে চলে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। । ভবানন্দ মজুমদার তাকে এই স্থান থেকে যেতে অনুরোধ করেন । বলা যেতেই পারে তিনি আর ফকির সাহেবকে এই স্থান থেকে আর যেতে দেননি । তিনি অনুরোধ করেন যে তিনি যেন এই স্থানে থেকে প্রজাদের মঙ্গল এর জন্য তিনি কবিরাজি মতে একই রকম ভাবি চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন । ভবানন্দের অনুরোধে আব্দুল্লাহ এই মাটিয়ারীতে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেন । মাটিয়ারী তে আব্দুল্লার জন্য একটি বাসগৃহ নির্মাণ করেছেন এবং তাকে মৌলি অল গজ উপাধিতে ভূষিত করেন রাজা ভবানন্দ মজুমদার । মলি অল শব্দের অর্থ বাদশা এবং গস্ শব্দের অর্থ ফকির । দুটিকে একত্রিত করলে হয় ফকিরের বাদসা । এইখানেই তিনি গড়ে তোলেন একটি আখড়া । এই আঁখ রায় প্রচুর রোগীরা আসতেন এবং ওষুধ সংগ্রহ করতেন । আব্দুল্লাহ র হাতের জাদুতে এলাকায় প্রচুর ভক্ত তৈরি হয় । বেশিরভাগ রুগী সুস্থ হওয়ার পর পীর বাবাকে গুরুদেব রূপে গ্রহণ করেন । সেখানে ই শীর্ষ শাবকেরা পীর বাবাকে ঘিরে থাকতে শুরু করেন । তিনি পরলোক গমন করার পর এই স্থানে সমাধি করা হয় । বর্তমানে পীর বাবার দরগা নামে পরিচিত হয় এই মাজারটি । দরগাটি পশ্চিম মুখী এটি নদীয়া জেলার সবচেয়ে প্রথম এবং প্রাচীন দরগা । ভাবানন্দ মজুমদারের সপ্তম পুরুষ রাজা রঘুনাথ দেই দরগার সন্মুখে একটি পুকুর খনন করেন এবং বেশ কিছু সম্পত্তি পীর বাবার নামে দান করেন । পীর বাবার মাজারে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে আরও দুটি সমাধি । কথিত আছে এই দুই সমাধি আসলে পীর সাহেবের দুটি প্রিয় শিষ্য । একজন ছিলেন ধোপা আর একজন ছিল নাপিত । এই দুই প্রিয় শিষ্য পীর বাবার সঙ্গেই পারস্য থেকে এসেছিলেন । পীর বাবা যেখানে যেতেন এই দুই শিষ্য তাদের পাশে থাকতেন সর্বদা । সমাধির সন্নিকটে একটি পাথরের থাম দেখা যায় । সাধারণ মানুষের কাছে যার নাম আশা বড়ি জাদু দণ্ড । যদিও এই পাথরের স্তম্ভ কেউ স্পর্শ করে না । হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির এক ঐতিহাসিক স্থান এই মাটিয়ারী বানপুর । শত শত বছর ধরে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে মানুষ এখানে মানত করেন নিজেদের শাস্ত্র মতে ধুপ, দ্বীপ জালে বাতাসা ছড়ায় দুধ ঢালে । যারা মানত করেন গাছে বাঁধেন ঢিল বা পাথর । মানত পূরন হলেই এই স্থানে এসে পুজো দেন সকলেই । পূজার উপকরণ স্বরূপ কেউ দিচ্ছেন হাঁস ,মুরগি, ছাগল ,ঔ সঙ্গে অবশ্যই নীল রঙের মাটির ঘোড়া । আরো একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় এখানে গেলে দেখা যায় । পীর বাবার মাজারে বাতাসা দুধ ধুপ দ্বীপ দেবার পাশাপাশি কেউ দিচ্ছেন নীল রংয়ের মাটির ঘোড়া । কেউবা দিচ্ছেন গোপালের মূর্তি । অম্বুবাচী তিথিতে পীরের মৃত্যু দিবস উপলক্ষে এখানে মেলা বসে । প্রথম সাতদিন একইভাবে চলে মেলা । যারা মানত করেন বেশিরভাগ মানবকারী মেলায় যারা পুণ্যার্থী আসেন তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেন । অবশ্যই হাত অথবা খিচুড়ি, সঙ্গে পায়েস এবং তরকারি ।এই মেলায় হিন্দু-মুসলমান সমস্ত ধর্মের মানুষ একত্রিত বসে খাওয়া-দাওয়া করেন । আগে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর ভক্ত আসতেন এই পীর সাহেবের মাজারে । এখন সীমান্তে তার কাটার বেড়া দেওয়াই বাংলাদেশের ভক্তরা আর আসতে পারেন না । তবে যারা ভিসা করে আসেন । যারা আসেন তাদের মধ্যে কেউ হিন্দু বা মুসলিম তারা প্রত্যেকেই তাদের ধর্ম অনুযায়ী পুজো দেন পীর সাহেবের মাজারে। এই মেলা চলে প্রায় এক মাস যাবত । মেলাকে ঘিরে সর্ব ধর্মের সমন্বয়ে ঘটে । শিয়ালদা থেকে গেদের ট্রেনে করে 125 কিলোমিটার দূরে বানপুর স্টেশনে নেমে মাটিয়ারীতে পৌঁছানো যাবে । অন্যদিকে কৃষ্ণনগর থেকে 36 কিলোমিটার দূরে কানপুরের বাসে বানপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে অটো অথবা টোটো গাড়িতে মাটিয়ারীতে পৌঁছানো যাবে ।