নদীয়ার শান্তিপুর এবং নীল চাষ ! হাতিশালা আজও অনাদরে মাথা উঁচু করে বহু ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সংরক্ষণের প্রতীক্ষায়

Social

মলয় দে নদীয়া :-সুদূর অতীতে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের কারণে এক সময় বাংলার দুঃখ ছিল নীল । তবে এই নিষ্পাপ উদ্ভিদটির কোনো দোষ ছিল না । বেনিয়া ইংরেজ তার হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এদেশের সহজ সরল কৃষক দ্বারা তাদের উর্বর ফসলের ক্ষেতে নীল চাষে বাধ্য করত । অনেক দুর্ভিক্ষের হোতা এই নীল। আবার সিপাহী বিদ্রোহের মত মহাবিদ্রোহের হোতাও এই নীল । বাংলার বেশকিছু জায়গায় আজও সেই সমস্ত কিছু নিদর্শন হয়ে গেছে, তবে বেশির ভাগই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে যার কোনো চিহ্ন পর্যন্ত বর্তমানে খুঁজে পাওয়া যায় না, তার মধ্যে নদীয়ার শান্তিপুর অন্যতম।

শান্তিপুরের হরিপুর বিল সংলগ্ন এলাকায় ১৮২০/২১সালে নীলকর সাহেবরা একটি নীল কুঠি স্থাপন করে এবং সেখানে নীল চাষ শুরু হয়। এই সময় হরিপুর বিল হরি নদী বন্দরের সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে জানা যায়। এটি পূর্বে ছিল নদীয়া মহারাজার সম্পত্তি। পরবর্তীকালে বিভিন্ন ব্যক্তিকে তারাই ইজারা দিতেন এবং তার পরে সেটি খন্ড খন্ড করে বিক্রয় হয়ে যায়। এই নীলকুঠিরের ভগ্নাবশেষ এখন সম্পূর্ণভাবে নিঃচিহ্ন। সেখানে গড়ে উঠেছে বসতি। আর একটা নীলকুঠির অস্তিত্ব পাওয়া যায় বর্তমান ১ নম্বর ওয়ার্ডের বানকের পাশে। এই জলাশয়টিকে আগে নেজোর বলা হতো। নির্ঝর থেকে কথাটি এসেছে। এই অঞ্চল রেশম কাপড়ের কুঠি ছিল বলে জানা যায়।

এইখানে একটি বৃহৎ বাড়ি ছিল জেটি কারখানা এবং অফিস বাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এছাড়াও সাহেবরা থাকতেন এখানে এবং তাদের হাতি থাকবার ঘরটিও বর্তমানে ভগ্না অবস্থায় দেখা যায়। যা হাতিশাল নামে পরিচিত, আজও অনাদরে মাথা উঁচু করে বহু ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সংরক্ষণের প্রতীক্ষায়।

এখানেই জার্মানি থেকে এসেছিলেন খ্রিস্টান পাদ্রী বম ওয়েচ সাহেব ।তিনি এখনে একটি ইংরেজী বিদ্যালয় খোলেন যেটি ওই কুঠির ঘরে চলত ।এছাড়া তিনি একটি ট্রেনিং স্কুল ও বালিকা বিদ্যালয় এখানে খুলে ছিলেন বলে জানা যায় শান্তিপুরের ইতিহাস সুত্র থেকে। এই বম ওয়েচ সাহেবের বিদ্যালয়ে বাল্যকালে মহাত্মা বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী শিক্ষা লাভ করেছিলেন।যতদূর জানা যায় প্রথম শান্তিপুরের ইংরেজি বিদ্যালয় এখানেই স্থাপিত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আরেকটু বলা যায় যখন বাংলাজুড়ে নীল বিদ্রোহ শুরু হয় শান্তিপুর তার ব্যতিক্রম ছিল না ।শান্তিপুরের বিশ্বনাথ সর্দার এর নেতৃত্বে একদল কৃষক নীলকুঠি আক্রমণ করাতে হয় নীলকর সাহেবরা পলায়ন করে । শান্তি পুরের জমিদার উমেশ চন্দ্র রায় বা মোতি বাবু নীল চাষের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পরবর্তীকালে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুক্ত হন।

শান্তিপুরের নীল বিদ্রোহের সঙ্গে একজন খ্রিস্টান পাদ্রীর
নাম বিশেষভাবে উচ্চারিত হয়। তিনি বম ওয়েচ সাহেব। তিনি নীলকর সাহেবদের অত্যাচার এবং চাষীদের স্বপক্ষে কথা বলেন বলে গির্জা থেকে বিতাড়িত হতে হয়। নীলকরেরা তাকে রাজনৈতিক মিশনারি ,দুর্বৃত্ত মিশনারি, মিথ্যা কথার জন্মদাতা বলে অভিহিত করে। কিন্তু শান্তিপুরের কৃষক সমাজ ,অত্যাচারিত নীলচাষীদের কাছে তিনি আদর্শ পুরুষ হিসেবে গণ্য হতেন।
নীলচাষের জন্য বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন নীলকুঠির আশেপাশে বসবাস করত। নীলকুঠি বা নীলচাষ না থাকলেও তারা আজও এখানে ভূমিপুত্র হয়ে থেকে গেছে।

ধরনের নানা স্মৃতি কাহিনী শান্তিপুরের ভূমিপুত্র কবি কালি কৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য,ডঃ হিন্দু নাথ নাথের বিভিন্ন লেখনীতে পাওয়া যায়।তবে বইয়ের পাতা থেকে সর্বসাধারনের মাঝে চিরস্মরণীয় করে রাখতে যাদের অগ্রণীভূমিকা থাকা উচিত, সেই সকল জনপ্রতিনিধিরাও উৎসাহিত নন। তাদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই বোঝা গেলো। বিধায়ক ব্রজ কিশোর গোস্বামী বলেন, প্রবেশ পথে একটি তোরণ করা হবে তাতে নাম লিপিবদ্ধ করা হবে, তবে সংরক্ষণের লক্ষ্য করা গেল না তার কথার মধ্য দিয়ে। শান্তিপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান সুব্রত ঘোষ, বলেন বিষয়টি তার জানা নেই। খোজ নিয়ে দেখতে হবে।

সাংসদ জগন্নাথ সরকার গৌরবান্বিত ইতিহাস হলে সংরক্ষণের প্রয়োজন তবে কলঙ্কিত হলে নিয়ে বাড়াবাড়ি করার দরকার নেই।

শান্তিপুরের বিভিন্ন ঐতিহ্য পরম্পরা এবং স্থাপত্য নিয়ে কাজ করা অমিতাভ মিত্র, আক্ষেপের সুরে বলেন স্থানীয় প্রশাসন পর্যটনের অন্তর্ভুক্ত করলে, একদিকে যেমন সংরক্ষিত হয় ইতিহাস, অন্যদিকে বেশকিছু কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হয়।

শান্তিপুরের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখালেখি করা এ প্রজন্মের রজত প্রামানিক জানান, ইতিহাসকে সংরক্ষণ করে রাখাই শিক্ষার অন্যতম দিক।

Leave a Reply