মলয় দে নদীয়া:- কাঁচা মিঠে আম, লিচু, তালশাঁসের বিপুল সমাহার নদীয়ার শান্তিপুর গাজীম মেলায়। ফল বিক্রেতারা জানাচ্ছেন বংশ পরম্পরায় বহু বছর ধরে এই রীতি চলে আসছে। আজ সন্ধ্যে থেকে কাল সকালের মধ্যে সমস্ত ফল বিক্রি হয়ে যাবে অভিজ্ঞতার নিরিখে এমনটাই আশা করছেন তারা।
বৈশাখ মাসের শেষ রবিবার শান্তিপুর গাজীম মেলার মাঠে আয়োজিত হয় কাল্পনিক গাজীম মিঞার বিয়ে। মুসলমান সম্প্রদায়ের বহু প্রাচীন এই মেলা দেখতে উপস্থিত হন আশেপাশের সর্ব ধর্মের মানুষ। হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই মিষ্টি ধূপ নিয়ে এসে পূজো দিয়ে যান তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী। তারা জানাচ্ছেন এখানে মানত করে ফল মিলেছে অনেকের ।
যদিও গাজীম মিঞা ছিলেন পারস্যের সুলতানের সেনাপতি। যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন তিনি। যুদ্ধে যাওয়ার আগে তাঁর বিয়ের দিন ঠিক হয়েছিল জহুরা বিবির সাথে। শেষমেষ পারিবারিক সমস্যার কারণে বিবাহের কাজ সম্পন্ন হয়নি, এই দুঃখে মারা যান জহুরা বিবিও। এই উপলক্ষে বহু প্রাচীনকাল থেকে দুটো বাঁশকে মাঠের মাঝখানে পাশাপাশি রঙিন কাপড় দিয়ে সাজানো হয় পড়ানো হয় মালা। তৃতীয় একটি কঞ্চি থাকে থাকে লগন বা ঘটক ভাগ্নে রুপে।
কিন্তু হাওয়ায় বাঁশে বাঁশে ঠোকাঠুকি লেগে বিয়ে ভেঙে গেলে ঘোষণা হয় পরের বছর আবারও বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। এই ভাবেই বছরের পর বছর ধরে এই অনুষ্ঠান হয়ে আসছে। সেই উপলক্ষে অনেকেই তাদের পরিবারের কল্যাণ, পারিবারিক সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে মানত করে থাকেন ছাগল মুরগি হাঁস এবং অন্যান্য খাদ্য দ্রব্য এলাকার স্থানীয় শিশু এবং ভবঘুরে মানুষকে খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে। সেই উপলক্ষে বৈশাখ মাসের দ্বিতীয় রবিবার ভাগ্নে হিসাবে বাঁশের কঞ্চি মামার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে পৌঁছায় মালঞ্চ মাঠ পার্শ্বস্ত আজগুবি তলায় জহুরা বিবির বাড়িতে। পাত্রীপক্ষ সম্মতি জানালে তৃতীয় রবিবার সম্পন্ন হয় গায়ে হলুদ। পাত্র এবং প্রার্থী দুপক্ষের দুটি বাঁশেই লাগানো হয় হলুদ। ইতিমধ্যেই আশেপাশের বহু মানুষ মানৎ অনুযায়ী তা পূরণ করতে হাজুত অর্থাৎ খাদ্যদ্রব্য নিয়ে পৌছে যান এই এলাকায়। দূরদূরান্ত থেকে মেলার বিক্রেতারা তাদের পসরা সাজিয়ে বসেন। এলাকায় উৎসবের চেহারা নেয় সর্বধর্ম সমন্বয়ে। এর পরে আসে প্রতীক্ষার শেষ রবিবার অর্থাৎ চতুর্থ রবিবার মানে আজ। যেখানে সাধারন বিবাহ মৌলানা সাহেব পড়ালেও এই বিবাহ পড়ান খাদেম সাহেব।
রীতি অনুযায়ী সরু বাঁশের ডগায় বিভিন্ন বিবাহের উপযোগী পোশাক পরানো থাকলে তা হাওয়ায় লাগে ঠোকাঠুকি, আবারো বাধা পারে বিবাহের। খাদেম সাহেব ঘোষণা করেন আবারো পরের বছরের এই দিনে বিবাহ অনুষ্ঠিত হওয়ার।
ধর্মীয় বিশ্বাস আবেগ নিয়ে এক বছরের প্রতীক্ষায় থাকে মানুষ। চমর দিয়ে মাথায় বুলিয়ে আশীর্বাদ করে থাকেন খাদেম সাহেব। এই উপলক্ষে দূরদূরান্ত থেকে শতাধিক দোকানী তাদের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ইতিমধ্যেই। স্থানিও সাত ভাই পাড়া বঙ্গবন্ধু ক্লাবের পক্ষ থেকে এই মাঠে বাজি উৎসব পালন করে থাকেন। তবে এবছর প্রশাসনিক অনুমতি মেলেনি বাজি পোড়ানোর। কিন্তু তাতে কি পাড়ায় পাড়ায় গাজীমের বিয়ে চলছে জোড় কদমে। অনেকে গাজীম মিঞাকে বাবা সাহেবের মেলা হিসেবেও জানেন। এই উপলক্ষে বিভিন্ন সময় জেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে স্থানীয় পৌরসভা বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন এবং তারাও উপস্থিত থাকেন সাধারণের মাঝে। শান্তিপুর পৌরসভা থেকে প্রকাশিত করা আমার শান্তিপুর নামক এক বইয়ে ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। এলাকার প্রবীণ দের মতে এই মাঠ রাজা হরিশচন্দ্রের দেওয়া ইছা হক খন্দকারকে।পূর্ব পাকিস্তানে তিনি চলে যাওয়ার সময় স্থানীয় মুসলমানদের উপর দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে যান। উদ্দেশ্য ছিল সমগ্র সম্পত্তি মুসলিম মুসলিম সম্প্রদায়ের এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে ব্যবহার হবে মাঠটি। এলাকাবাসীদের আশঙ্কা স্থানীয় কিছু প্রোমোটার জমির নাম পরিবর্তন করিয়ে ব্যবসায়িক ক্ষেত্র গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। তবে হাজারো মানুষের বিশ্বাস বহু প্রাচীন রীতি আঁকড়ে ধরে ঐতিহ্য বজায় রাখতে চেষ্টা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। মাঠ রক্ষার ব্যাপারে জেলা প্রশাসন থেকে স্থানীয় প্রশাসন সবাইকেই লিখিতভাবে এলাকার সকলেই অনুরোধ জানিয়েছেন।