মিশর ভ্রমণ (দ্বিতীয় পর্ব )

Social

নিউজ সোশ্যাল বার্তা, ১০ই নভেম্বর ২০১৯,সঞ্চিতা মন্ডল : দরজা ঠক ঠক আওয়াজ। চোখ কচলে উঠে দরজা খুললাম দেখি মা ওঠাতে এসেছে আমাকে আর আমার দিদি কে। মা-বাবা ভালো করেই জানে আগে ইউরোপ ঘোরার সুবাদে যে বিদেশ গ্রুপ এ ঘুরতে গেলে সময় অনুসারে সব কিছু করতে হয়। মা বললো ওঠ ৫ টা বাজতে চললো। আমি মনে মনে ভাবছি ৫ টা বাজতে চললো কিন্তু মোবাইল এ অ্যালার্ম বাজলো না কেনো? মোবাইল নিয়ে দেখি ও বাবা এত পরম আনন্দ ! মা কে তাড়াতাড়ি বললাম যাও মা আরেকবার গিয়ে শুয়ে পড়ো। মা বললো আমি ফ্রেশ হয়ে গেছি এবং স্নান ও সেরে নিয়েছি। আমি বললাম তাতে কি হয়েছে যাও গিয়ে আরেকবার শুয়ে পড়ো । আমার ঘুমটা চটকে দিও না। এখন সবে যে ৩.৫৪। এত কাণ্ড মা এর সঙ্গে হলো মিনিট ৫ দিদি কিছু জানতেই পারলো না বা চেষ্টাও করলো না জানার। ঘুমিয়ে পরলাম আবার । যথারীতি সময় মত উঠে ফ্রেশ হলাম স্নান সেরে নিলাম সাজু গুজু করে দুই বোন বেরোলাম বাবার তাড়া খেয়ে কোনরকমে । কেননা তখন ৬.২০ বেজে গেছে। ব্রেকফাস্ট করে ৬.৪৫ মিনিটে লবিতে পৌঁছাতে না পারলে যদি গ্রুপ ছেড়ে চলে যায় এই ভয় আমার বাবার মনে সবসময় কাজ করে। বিদেশ বিভূঁই বলে কথা। ব্রেকফাস্ট কন্টিনেন্টাল। ব্রেকফাস্টে নানা রকমের পাউরুটি, ফ্রুটস, কর্নফ্লেক্স , দুধ ডিম সেদ্ধ, জুস আরো অনেক কিছু। যাক ৬.৫৫ মিনিটে ব্রেকফাস্ট করে লবি তে হাজির হলাম। আজ যাবো আলেকজান্দ্রিয়া। আমরা ২৯ জন সঙ্গে টুর ম্যানেজার সৌম্য সাথী বিশ্বাস এবং টুর গাইড ফারুক। বাস ছাড়ার আগে আমাদের টুর ম্যানেজার হারাধন এর ২৯ টি ছেলেকে গুনে নিল ঠিক আছে কিনা । বাস ছাড়ল । ছাড়ার পর আমাদের কে ১ লিটার করে প্রাপ্য জল টুর ম্যানেজার দিয়ে দিল। হোটেল এর রুমে যে জল দিয়েছিল এক লিটার সেটা ব্যাগ এ রেখে এসেছিলাম সযত্নে। এই ভেবে রেখেছিলাম যদি জলের বোতল শেষ হয় নি দেখে হোটেল কতৃপক্ষ ওই ১লিটার জল না দিয়ে থাকে তাই। বাস ছুটে চলেছে। বাসের মধ্যে কেও ঘুমে ঢুলছে কেউ বা গান শুনছে। যাক কিছুক্ষন পর থামলো বাস বাথরুম করার জন্য। সব জায়গাতে বাথরুম করার জন্য টাকা লাগে। ওই কোথাও ২ পাউন্ড কোথাও আবার ৩ পাউন্ড। বাস থেকে নেমে আমরা দুই বোন একটু ফটো সেশন করে নিলাম। বাস ছাড়ল আবার। হারাধন এর ছেলেদেরকে আবার গুনে নিল টুর ম্যানেজার। তার সঙ্গে টুর ম্যানেজার বললো আমাদের লাঞ্চ হবে বাইরে মানে আলেকজান্দ্রিয়া তে। তাই কে non veg এবং veg খাবে এখনই বলে দিতে হবে । তার সঙ্গে বলে দিল veg and non veg এ কি কি খাবার থাকবে। আমি যেহেতু non veg খাই নন ভেজ খাবার এর ব্যাপার জানতে চাইলাম। বললো নন ভেজ খাবার এ থাকবে ফিশ। মাছ দুরকম ভাবে রান্না। গ্রিলড ফিশ আর ফ্রাই ফিশ। তার সঙ্গে থাকবে মশলা স্টিকি রাইস শটেড সবজি ( মানে সেদ্ধ করে অল্প তেলে ভাজা) স্যালাড রুটি ।আমরা যেহেতু চারজন ছিলাম তাই তিনটে ফিশ ফ্রাই প্লেট এবং একটা গ্রিলড ফিশ বললাম ।

সব কিছু টেস্ট করার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে টুর ম্যানেজার বলল মেনু কিন্তু চেঞ্জ করতে চাইলে হবে না। অনেক বড়ো রেস্টুরেন্ট অনেক লোক জন খায় তাই এখন থেকে খাবার অর্ডার করলে আমরা লাঞ্চ এর সময় গিয়ে তবেই পাবো । তার সঙ্গে এটাও বলে দিল জল রেস্টুরেন্ট এ বাইরে থেকে নিয়ে যেতে পারবেন না। ওখান থেকে কিনে তবেই খেতে হবে না হলে বাসে এসে জল খাবেন।

এইসব হতে হতে রাস্তার দুপাশে দেখলাম বিরাট বড়ো লেক। দেখতে দেখতে আর ছবি তুলতে তুলতে গেলাম ।

যাই হোক ৩ ঘণ্টা জার্নি করার পর অতঃপর পৌঁছলাম আলেকজান্দ্রিয়া শহরে।শহর টা দেখেই যে খুব ভালো লাগলো তা কিন্তু নয়। খুব ঘিঞ্জি শহর। প্রচুর ঘিঞ্জি বাড়ি । লম্বা লম্বা উঠে গেছে আকাশের দিকে। বাড়ি গুলোর বৈশিষ্ট্য হলো দুধারে ইট দেখা যাচ্ছে শুধুমাত্র সামনের দিকের অংশ টি প্লাস্টার করা। আকাশের দিকে যেমন উঁচু বাড়ি তেমনি দৈর্ঘ্যে লম্বা লম্বা বাড়ি প্রস্থে কিন্তু তেমন চওড়া নয় ওখানকার বাড়ি গুলি। বলতে ভুলে গেছি রাস্তার মধ্যে ট্রাম লাইন এ দেখলাম। বুঝলাম তারমানে ট্রাম চলে।। রাস্তা ও খুব সংকীর্ণ এবং অপরিষ্কার।। আসলে কায়রো এবং আলেকজান্দ্রিয়া শহর দুটো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মোটেই নয় ।যত্র তত্র নোংরা পড়ে আছে। যেটা ইউরোপের দেশগুলিতে এইগুলো স্বপ্নেও চিন্তা করা যায় না। এই দুটো শহরকে দেখে কখনই প্রথম দেখায় প্রেম যেটা বলে সেটা হবে না। এই সব কথা চিন্তা করতে করতে আমাদের গাইড মাইক ধরে আলেকজান্দ্রিয়া শহর নিয়ে বলতে শুরু করলেন।

ভূমধ্যসাগর এর তীরবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত হাওয়ার জন্য এই আলেকজান্দ্রিয়া শহরটি ইজিপ্ট এর একটা প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্রস্থল বলা যেতে পারে। ভূমধ্যসাগরের নামটা শুনেই আমার মনে যেন একটা হালকা বাতাস বয়ে গেলো। ভূমধ্যসাগর দেখতে পাবো। ভূগোলের ছাত্রী এবং শিক্ষিকা হাওয়ার সুবাদে কত বার কত কথা পড়েছি এবং পড়াচ্ছি। মনে পড়ে গেলো ভূমধ্যসাগর কে তো ফলের ঝুড়ি বলা হয় আরো কত কি ? গাইড বকে যাচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তে গাইড বললো এই শহরের নামকরণ হয়েছে ম্যাসিডনের রাজা গ্রেট আলেকজান্ডারের নাম অনুসারে। এই শহর রোমান এবং ইজিপ্টের লোকেদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এই কথা শুনতে শুনতে এসে পৌঁছলাম দর্শনীয় স্থানে। স্থান

The Catacomb নামটি শুনেই বুঝতে পারছেন ভূগর্ভস্থ সমাধিক্ষেত্র। টুর ম্যানেজার হাতে টিকিট ধরিয়ে দিয়ে এগোতে বললো। টিকিট মূল্য ৮০ পাউন্ড। ঢুকলাম গাইড বকতে শুরু করলো রোদ্রের মধ্যে দাড় করিয়ে। অর্ধেক কথা শুনলাম অর্ধেক শুনলাম না। স্থানটির ব্যাপারে বুঝলাম এটা একটা burial স্থান ছিল গ্রিক রোমানদের। যাইহোক কুয়োর মত জায়গা দিয়ে সিড়ি দিয়ে নিচে নামলাম। দেখলাম টানেল এর মত অনেক ঘর করা আছে। যেখানে মৃত দেহ গুলো কে রেখে যেত । অনেক কিছু দেওয়ালে খোদায় করা আছে। বিরাট কিছু দেখে ভালো লাগলো না আমার জায়গাটা। ছবি তুলে উপরে উঠে এসে বাসে চাপলাম।

দ্বিতীয় গন্তব্যস্থল Pompey’s Piller।জায়গাটি catacomb এর একদম কাছেই। টিকিট হাতে ধরিয়ে দিল গাইড এর পেছনে পেছনে চলতে শুরু করলাম । পিলারটির ব্যাপারে বুজলাম কোনো এক রাজার যুদ্ধ জয়ের স্মৃতি হিসেবে নির্মিত হয়েছিলও। একটাই গ্রানাইট পাথর দিয়ে তৈরি বড়ো স্তম্ভ টি। যাক ঘুরে ঘুরে দেখে ফটো তুলে বাবার চিৎকার শুনে চলে এলাম। আর এই ভেবে বাসে উঠলাম শুধু এই ধ্বংস স্তূপ দেখার জন্য মিশর এসেছি ! যাক এইসব ভাবতে ভাবতে টুর ম্যানেজার বললো আমরা এইবার লাঞ্চ এ যাবো। বাস যাচ্ছে যেতে যেতেই দেখতে পেলাম ভূমধ্যসাগর কে। আহা ! এইতো এটাই চাইছিলাম। মন আনন্দে ভরে উঠলো। নীল জল মনে হলো আমাকে যেন দু-হাত বাড়িয়ে ডাকছে। আর বলছে তোর এতদিনের অপেক্ষা শেষ হলো শেষমেশ আমি দেখা দিয়েই দিলাম । এই ভাবতে ভাবতে পৌঁছলাম খাবার জায়গাতে। The fish market। পাশেই ভূমধ্যসাগর। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে দেখলাম ভূমধ্যসাগর । ছবি তুলতে শুরু করে দিলাম। দেখতে পেলাম মাছ গুলোকে কাঁচের ঘরের মধ্যে বরফের মধ্যে রাখা আছে। এইসব সেরে খাবার টেবিলে বসলাম ।আগে থেকে বলে রাখা খাবারগুলি এল । ফিশ এলো দেখলাম KFC চিকেন যেমন করে ভাজা হয় তেমনি করে ফিশ রান্না করেছে। আহা! কি সুন্দর সুন্দর খেতে । লাঞ্চ সেরে বাসে উঠলাম। আবার হারাধন এর ছেলেদের গুনে নিল টুর ম্যানেজার। মন টা আমার আনচান করছে। কখন একটু ভালোভাবে ভূমধ্যসাগর এর কাছে গিয়ে বসতে পারব।

বাস ছাড়ল। ভূমধ্যসাগরের পাশ দিয়ে ছুটে চললো আমাদের বাস আর আমি দুই নয়ন ভরে দেখতে দেখতে গেলাম। তার সঙ্গে গাইড দেখাতে লাগলো কোনটা বড়ো লাইব্রেরী, কোনটা বড়ো হোটেল যেখানে বড়ো বড়ো তারকারা এসে থাকেন ইত্যাদি।

পুরো আলেকজান্দ্রিয়া শহরটিকে ভূমধ্যসাগর ঘিরে রেখেছে নেকলেসের মত। বাগানের মতো জায়গা দিয়ে বাসটি নিয়ে গেলো।সেই বাগানটিতে প্রচুর খেজুর গাছ। আর দেখালো ওই বাগানের ভেতর একটি রাজপ্রাসাদ আছে। বাস থেকে নেমে ফটো তুলতে শুরু করলাম। আর ভূমধ্যসাগরকে আলিঙ্গন করলাম। আহা ! কি সুন্দর! শুধু নীল নীল আর নীল ।বইয়ের পাতার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে শুরু করলাম। ফটো তুললাম অবশ্যম্ভবী স্মৃতি হিসাবে নিয়ে যাওয়ার জন্য ।ফটো তুলে সবাই বাসে উঠে পরলাম।

বাস ছুটতে শুরু করলো আবার ভূমধ্যসাগরের পাশ দিয়ে। শেষ বারের মত বাসের জানালা দিয়ে মন ভরে দেখে নিতে নিতে কখন যে বাসের মধ্যে ঘুমিয়ে গেছি বুঝতে পারি নি। ঘুম ভাঙতেই দেখি বাস ছুটে চলেছে কায়রোর দিকে হাইওয়ে দিয়ে। ৬.৩০ মিনিটের সময় হোটেলে পৌঁছলাম। ফ্রেশ হয়ে আবার লবি তে এলাম ওই যে ফ্রিতে wifi পাওয়া যায় । ইজিপ্টে Facebook whatsaap এ শুধু মেসেজ পাঠানো যায়। ফেসবুকে ফটো আপলোড করা যায়। কিন্তু যদি ভাবেন কলিং করবো সেটা কিন্তু হবে না। Whatsaap কলিং হবে VPN এর মাধ্যমে ।আমি পারি নি whtasap কলিং করতে। তবে Viber app দিয়ে কলিং হবে। আমরা কোনো সিম কার্ড কিনে নিয়ে যাই নি। কিছুক্ষন পর ৮ টা নাগাদ হোটেলে ডিনার সেরে নিলাম। টুর ম্যানেজার বলে দিলো কালকে উঠতে হবে আবার সকাল ৫টাতে। ব্রেকফাস্ট ৬ টায় করে নিয়ে ৬.৪৫ মিনিটে লবিতে হাজির হতে হবে।।কেননা পিরামিড এর দেশে এসে পিরামিড দেখতে না গেলে হয় বলুন? যাবো পিরামিড দেখতে। গেলাম ঘুমের দেশে। সারাদিনের ক্লান্তি কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতেই পারিনি। ( ক্রমশ)

Facebook Page: News Social Barta 24×7