ব্রিটিশ আমল থেকে চলছে নদীয়ার মাজদিয়াতে ডাকাতে কালি পুজো

Social

ডাকাতে কালি।

অঞ্জন শুকুল, নদীয়া: ডাকাতি করে এসে ডাকাতরা করত মা কালীর পুজো, তাই এই কালীর নাম ডাকাতে কালী । এই পুজো এবারে ১০৮বছরে পড়ল। ভীষণ জাগ্রত এই ডাকাতে কালী পুজোতে জড়িয়ে রয়েছে এলাকার প্রচুর মানুষ,অনেকেই মনোবাসনা পূর্ণ করতে মানত করেন। নদীয়ার মাজদিয়ার ঘোষপাড়ার ডাকাতে কালীতলায় ধুমধাম করে পুজো হলো এবারেওব।

প্রাচীন এই পুজোকে ঘিরে রয়েছে দারুণ কাহিনী । গ্রামবাসীরা জানান ব্রিটিশ আমলে ওই গ্রামের দিন কাটছিল অভাব -অনটনের মধ্যে দিয়ে, অনেকই পাচ্ছিলেন না দুবেলা -দুমুঠো খাবার । সেই করুন অবস্থার জন্য ওই গ্রামের কয়েকজন তরতাজা যুবক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তারা ডাকাতি করবেন । ডাকাতি করেই যোগাড় করবেন গ্রামের মানুষের জন্য খাবার।

তখন চলছে কড়া ব্রিটিশ শাসন, হটাৎ -ই ওই যুবকেরা খবর পান ,ঢাকার দিকে যাচ্ছে ব্রিটিশদের মালবাহী ট্রেন। ওই ট্রেনটিতে তারা ডাকাতি করার সিদ্ধান্ত নেন। রাতের দিকে মাজদিয়ার ইছামতি ব্রিজের ওপর দিয়ে ব্রিটিশদের মালবাহী ট্রেনটি যাচ্ছিল। সেই সময়ে হাতে লন্ঠনের লাল আলো দেখিয়ে ব্রিজের ওপরই দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল ট্রেনটিকে। সময় নষ্ট না করে ট্রেনের বগি থেকে কাপড়ের বান্ডিল বেশ কয়েকটা ফেলে দিয়ে লুট করা হল খাদ্যসামগ্রী ।বেশ কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দেওয়া হয় ট্রেনটিকে।

ট্রেন বেড়িয়ে গেল ঠিকই  কিন্তূ অল্প সময়ের মধ্যেই খবর পৌঁছে গিয়েছিল ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে, শুরু হয়ে গেল খোঁজা -খুঁজি। ডাকাতদলের লোকজন আশ্রয় নিয়েছিলেন জঙ্গলে । ব্রিটিশ বাহিনী কাপড়ের বান্ডিলের হদিশ পাইনি।সেই কাপড় তুলে ও লুট করা খাদ্য সামগ্রী ওই ডাকাতেরা গ্রামের মানুষের মধ্যে বিলি করেন । কিন্তু যারা করেছে এই কাজ ,তাদের সন্ধানে ব্রিটিশদের খোঁজ খবর চলছিল কড়াভাবেই ।

ওই এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে ,ওই ডাকাতদলে ছিলেন দুলাল প্রামাণিক ,হেমন্ত বিশ্বাস ,ভরত সর্দার ,কৃত্তিবাস মিত্র ,অবিনাশ ক্যারিয়া ,গিরীন্দ্রনাথ ঘোষ নামে কয়েকজন যুবক। ব্রিটিশবাহিনীর কাছে ধরা পড়ার ভয়ে জঙ্গলেই কাটতে লাগল তাদের সময় । সেইসময় তারা স্মরণ করেছিলেন মা কালীকে বলেছিলেন ,’মা তুমি বাঁচিয়ে দাও, আমরা তোমার পুজো দেব । ‘অলৌকিকভাবেই ব্রিটিশরা তাদের সন্ধান পায়নি। ব্রিটিশবাহিনীর ফিরে যাওয়ার পরদিনই ছিল অমাবস্যা কালীপুজো। জঙ্গল থেকে বেড়িয়ে একটি বেল ও নিম গাছের পাশেই বেদি বানিয়ে ডাকাতরা করেছিলেন মা কালীর পুজোর আয়োজন। জোর করে ভূদেব মালাকার নামে একজন প্রতিমাশিল্পীকে ধরে এনে প্রতিমা বানানো হল, গ্রামের চক্রবর্তী পরিবারের লোককে দিয়ে বাধ্য করানো হল পুজো করতে। প্রতিমা বানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রং করিয়ে পাটে তোলা হল মায়ের প্রতিমা ।

সেইসময়ের ডাকাত হেমন্ত বিশ্বাসের পরিবারের সদস্য সুনীল বিশ্বাসের কাছ থেকে জানা গিয়েছিল এই কাহিনী । যদিও সেদিন যারা ডাকাত বলে পরিচিত ছিলেন ,তাদের মাজদিয়ার ভেরিপাড়ার মানুষ সন্মানের চোখেই দেখেন । তাদের বক্তব্য ,’ওঁরা ডাকাতি করতেন ঠিকই ,তবে কোনদিন মানুষ খুন করেননি ,শুধু তাই নয় ,ডাকাতি করা জিনিসপত্র তারা বিলিয়ে দিতেন গ্রামের মানুষের মধ্যেই , তারাই আবার ডাকাতির টাকা -পয়সা দিয়ে করতেন মায়ের পুজো। তাই এইখানে মা কালী ডাকাতে কালী বলেই পরিচিত l

‘যদিও সেদিনের সেই ডাকাতদের পরিবারের উত্তরসুরিরা বর্তমানে কেউ শিক্ষক ,কেউ পুলিশ ,কেউ সেনাবহিনীতে কাজ করেন। সেদিন ডাকাত হেমন্ত বিশ্বাসের পরিবারের সদস্য সুনীল বিশ্বাস একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক । তার কাছ থেকে এই তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। তার মুখ থেকে জানা যায়,’বছরে কয়েকবার ডাকাতি করা ছিল তাদের নেশা। তবে কালীপুজোর আগে ওঁদের ডাকাতি করা চাই -ই l নইলে যে মায়ের পুজো হবে না l একবার ওঁদের ডাকাতি আটকাতে পুলিশ ওঁদের থানায় নিয়ে গিয়ে আটকে রাখল সন্দেহের বশে! থানার সামনে চাদর -কম্বল মুড়ি ওঁরা ষোল -সতের জন শুয়ে থাকল ।পরদিনই কালীপুজো ! কী হবে ?অনেক রাত হয়ে গিয়েছে । গ্রামের কয়েকজন পুলিশের নজর এড়িয়ে ওঁদের চাদর -কম্বলের তলায় আশ্রয় নিল । ওঁরা বেড়িয়ে গেলেন ডাকাতি করতে । ডাকাতি সেরে ডাকাতির মালপত্র এক জায়গায় রেখে ওঁরা নিজেদের জায়গায় ফিরে এসে কম্বলের তলায় শুয়ে পড়ে । যারা আগে থেকে ছিল ,তারা বেড়িয়ে আসে, পুলিশ বুঝতে পারেনি । পরদিন ওঁরা ছাড়া পেয়ে মায়ের পুজো দিলেন, বাকি সামগ্রী গ্রামের মানুষদের বিলিয়ে দেন। আসলে ওঁরা সবসময়ই মাকে স্মরণ করতেন, ডাকাতি করতেন গরীব মানুষদের জন্য ।

জানা যায় ,ওঁরা কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি ,ট্রেজারিতেও ডাকাতি করেছেন , মুখে মুখে আজও ঘোরে একটা গল্প । একবার রাজবাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়ে পাহারাদারকে ওঁদের একজন অভিনয় করে বলেন ,বাবু আমার ছেলের শরীর খুবই খারাপ  একটূ সাহায্য করুন । পাহারাদার ভেতর থেকে কিছু সাহায্য করতে ওদের ওই একজন বলেন ,বাইরে এসে দিতে বাইরে আসতেই তাকে বেঁধে ওঁরা ডাকাতি করেন । রণপা পরে ওঁরা যেতেন ডাকাতি করতে । যাতে পায়ের চিন্হ না থাকে l ওঁরা অনেক ডাকাতি করে তা গ্রামের মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে ডাকাতির টাকা দিয়েই মা কালীর পুজো দিতেন।

গোষ্ঠ তরফদার জানালেন ,’কালীপুজোর আগে ওঁরা ডাকাতি একটা হলেও করতেনই। যদিও বাংলাদেশের দর্শনাতে একবার ডাকাতি করত যাওয়ার পর থেকে ঘটেছিল একটা অদ্ভুত ঘটনা l ওইখানেই কর আদায়ের দায়িত্বে ছিলেন যে রানী ,তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ডাকাতদল হানা দিয়েছে। এইখান থেকে ডাকাতরা ওইখানে ডাকাতি করতে গিয়ে স্বাক্ষী হন সেই অদ্ভুত ঘটনার দেখেন ,ঢোকার মুখে যেন স্বয়ং মা দাঁড়িয়ে । যিনি বলেন ,তোরা কথা দে ,আর তোরা ডাকাতি করবি না l আসলে ওঁদের শিক্ষা দিতে ওই রানী নিজেই নগ্ন হয়ে মা কালীর রুপ নিয়েছিলেন হ্যাঁ ,সেদিনের পর থেকে ওঁরা ডাকাতি বন্ধ করে দেন। ‘পরবর্তীকালে গ্রামের ঘোষপাড়ায় চাঁদা তুলে মায়ের মন্দির গড়ে তোলেন আজও ডাকাতদের সেই কালী -ই ডাকাতে কালী নামে পুজো হয়ে আসছে। এই কালী এইখানকার মানুষের কাছে অত্যন্ত জাগ্রত,বহু মানুষ এইখানে মায়ের পুজো দেন, পুজোর দিন হয় পাঁঠা বলি।

আজ প্রথা মেনে ভ্যাত্রীদিতিয়ার দিন কাঁধে করে পুরো মাজদিয়া বাজার ঘুরে ডাকাতে কালিকে বিসর্জন করা হয় মাথা ভাঙা নদীতে।

Leave a Reply