দেবু সিংহ ,মালদা : করোনা সংক্রমনের মধ্যে বিনামূল্যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা পরিষেবা দিচ্ছেন ডা: জোয়েব ফারহাদ বিশ্বাস। কালিয়াচকের জালালপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে এখন কলকাতার কেপিসি মেডিকেল কলেজের ডিগ্রিধারী ডা: জোয়েব ফারহাদ বিশ্বাস সাধারণ মানুষের কাছে নয়নের মনি হয়ে উঠেছেন। কেউ আবার ওই ডাক্তার বাবুকে হিরো বলে ডাকতে শুরু করেছেন। কাঁচা মাটির রাস্তা পেরিয়ে প্রতিদিন সকালে মোটরবাইকে গ্রামের বাড়ি বাড়ি চিকিৎসা দিতে ছুটে চলেছেন । জন্মসূত্রে কালিয়াচক মোজামপুর এলাকার বাসিন্দা হলেও ছোট থেকেই তিনি পড়েছেন ভিন রাজ্যে। পরবর্তীতে কেপিসি মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস সম্পূর্ণ করে শুরু করেন চিকিৎসা। কিন্তু কয়েক বছর বাইরে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার পরেও মন টেকেনি জোয়েব ফারহাদ বিশ্বাসের । মাটির টানে গ্রামের দুঃস্থ অসহায় মানুষদের পরিষেবা দিতেই ফিরে এসেছেন কালিয়াচকে।
মঙ্গলবার জালালপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ফতেখানি গ্রামে শতাধিক গরীব মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা দেন জেনারেল ফিজিশিয়ান ডা: জোয়েব ফারহাদ বিশ্বাস, তাঁর সঙ্গে ছিলেন তার দুই সহকর্মী ডা: ওয়াসিম আকরাম এবং ডা: মামুন আল হাসান । একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ অন্যজন দন্ত বিশেষজ্ঞ। ওনারাও জন্মসূত্রে কালিয়াচকের বাসিন্দা । তবে এখন ভিন রাজ্যে যাওয়ার কোনো চিন্তা-ভাবনা করছেন না । এমনকি কলকাতায় চেম্বার থাকলেও তা বন্ধ করে কালিয়াচকের গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেছেন তিনি। আর গ্রামবাসীদের কাছে এখন এই ডাক্তারবাবু নয়নের মনি হয়ে উঠেছেন।
মঙ্গলবার গ্রামে গিয়ে দেখা যায় অনেকেই বলছেন হ্যালো ডাক্তার বাবু । কথাটা শুনে অবাক হওয়ার মতই । সাদামাটা পোশাকে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেল চিকিৎসককে। চোখের সামনেই সাধারন মানুষের সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি। হাতে টেথিস্কোপ এবং প্রেসার মাপার মেশিন নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন রোগীর বাড়িতে। রুগীর দেখার পর প্রেসক্রাইব করে বিনামূল্যে ওষুধ দিচ্ছেন ডাক্তারবাবু। যেটা গ্রামবাসীদের কাছে অসাধ্য সাধন । তারা ভাবতেই পারেননি এরকম ঘটনা ঘটতে পারে গ্রামে।
বলাবাহুল্য, বোমাবাজি, জালনোট , সংঘর্ষ, খুনের ঘটনায় বারবার শিরোনামে উঠে এসেছে মালদা কালিয়াচক। কিন্তু এখন সেই কালিয়াচকের মুখ উজ্জ্বল করেছেন এলাকার ছেলে ডা: জোয়েব ফরহাদ বিশ্বাস ।
ফতেখানি গ্রামের বাসিন্দা সাবিনা বিবি, কামাল হোসেনরা বলেন, আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি গ্রামে বসেই চিকিৎসা পরিষেবা পাব। গ্রাম থেকে মালদা শহরে গিয়ে ডাক্তার দেখানো খুবই কষ্টকর। করোনা সংক্রমনের মধ্যে অধিকাংশ ডাক্তার প্রাইভেট চেম্বারে বসছেন না। মেডিকেল কলেজে রোগীদের আউটডোরে ঠেলাঠেলি অবস্থা । কিন্তু এখন গ্রামের ছেলে ডাক্তার হয়ে ফিরে এসেছেন। শুনে মনে হবে যেন রূপকথার গল্প। কিন্তু এটাই বাস্তব। তাই ডাক্তার দেখানো নিয়ে এখন আর আমাদের চাপ নেই । যখনই অসুস্থ রোগীর কথা শুনতে তখনই ছুটে আসছেন রোগীর বাড়ি । রোগ নির্ণয় করে ওষুধ দিচ্ছেন। তাও আবার বিনামূল্যে । এরকম ঘটনা কালিয়াচকের মানুষের কাছে ইতিহাস হয়ে থাকবে।
জালালপুর গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য মহম্মদ জিয়াউল হক বলেন, এলাকার অনেক দুর্গম এলাকায় রয়েছে। সেখানকার মানুষদের যাতায়াতের ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা হয়। তার মধ্যে করোনা সংক্রমণ চলছে। শহরে প্রাইভেট ডাক্তার দেখানো খুব কষ্টকর । এরইমধ্যে গ্রামের ছেলে ডাক্তার হয়ে ফিরে এসেছেন। তিনি নিজেই বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। রোগী দেখছেন। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ওষুধ দিচ্ছেন। আমাদের কাছে উনি এখন দেবদূতের মতোই। তাই মানুষ দুই হাত তুলে ওনাকে আশীর্বাদ করছেন।
জালালপুর গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান জুলফিকার আলী বলেন, আজকের দিনে সবকিছু পাওয়া সম্ভব । কিন্তু বাড়িতে বসে ডাক্তার পাওয়া এটা স্বপ্ন। রোগী দেখতে ডাক্তার বাড়িতে আসবেন, বিনা পয়সায় চিকিৎসা করবেন ,ওষুধ দিবেন , এটা যেন লটারি পাওয়ার মতো। গ্রামের ছেলে ডাক্তার হয়ে ফিরে এসেছেন । সাধারণ মানুষের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। চিকিৎসা পরিষেবা দিচ্ছেন উনি। আমাদের কালিয়াচকের নাম উজ্জ্বল করেছে। আমরা পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে উনাকে নির্দিষ্ট একটি অফিস ঘর করে রোগী দেখার ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেবো।
ডা: জোয়েব ফারহাদ বিশ্বাস বলেন, ছোট থেকেই স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার । নিজের স্বপ্ন পূরণ করেছি। দীর্ঘদিন বাইরে থেকেছি । এমবিবিএস সম্পূর্ণ করার পর, জেনারেল ফিজিশিয়ান হয়ে কলকাতা এবং বাইরে রাজ্যে দীর্ঘদিন প্র্যাকটিস করেছি। কিন্তু মন বসাতে পারিনা। গ্রামের মানুষ অনেক কষ্টে আছে । করোনা সংক্রমনের মধ্যে ওদের দেখতে হবে । তাই নিজের জন্মভিটে কালিয়াচকে ফিরে এসেছি । যতদিন পারব গাঁটের টাকা খরচ করে চিকিৎসা চালিয়ে যাব । জানি না ভবিষ্যতে কি হবে। আমার ছোট বোন আলিশা পারভীন উনিও পুনেতে ডাক্তারি করছেন। বড় ভাই ব্যবসায়ী । সবাইকে নিয়েই এখন খুব ভালো লাগছে। যতদিন বাঁচবো এই ভাবেই গ্রামের দুঃস্থ ও অসহায় মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে যাব ।