প্রীতম সরকার: বরাবর আমার বৌদ্ধ গুম্ফার রহস্যের প্রতি আকর্ষন। এখনও পর্যন্ত কত গুলো গুম্ফা যে ঘুরেছি, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু সব জায়গাতেই শুনতাম, হিমালয়ের কোলে ধরমশালায় যে বৌদ্ধ গুম্ফা রয়েছে, তার রহস্য না কি একেবারেই আলাদা। এখানে বৌদ্ধধর্মের প্রবাদপুরুষ দলাই লামা নিয়মিত যাতায়াত করেন। না ! আমার ভাগ্যে দলাই লামাকে দর্শন করা হয়ে ওঠেনি। আমি যে সময় গিয়েছিলাম, তখন দলাই লামা অন্য কোথাও ছিলেন। যাইহোক, ধরমশালার গুম্ফার সাথে হিমালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখবো বলে ২০১৭ সালের অক্টোবরের পূজোর ছুটিতে হাজির হয়েছিলাম ধরমশালাতে।
ধরমশালা অন্য পাহাড়ি শহরের মতো হলেও এখানকার শহরের সৌন্দয্যায়ন কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। ধরমশালার আবহাওয়া অত্যন্ত মনোরম। সেখানে পাহাড়ের উপরে এক বিশাল ষ্টেডিয়াম রয়েছে। সেখানে নিয়মিত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ হয়। আমি, আমার স্ত্রী এবং মেয়ে একদুপুরে ধরমশালায় পৌঁছে আগে থেকে ঠিক করে রাখা হোটেলে উঠে আমি কাজে রাস্তায় নেমেছিলাম। হঠাৎ পুলিশের সাইরেন শুনে তাকিয়ে দেখি একটি ভলভো বাসকে পুলিশ স্কট করে নিয়ে যাচ্ছে। বাসের দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকেতেই দেখতে পেলাম বাসের জানালার পর্দার আড়ালে বসে রয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক বিরাট কোহলি। তাঁর কানে গোঁজা হেডফোন। বাসের অন্য জানালা গুলির ভারী পর্দা থাকার কারনে অন্য খেলোয়াড়দের দেখা হয়নি। হোটেলের এক ষ্টাফকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, দুদিন পরে ধরমশালা ষ্টেডিয়ামে ভারতীয় ক্রিকেট দলের সঙ্গে অষ্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ম্যাচ রয়েছে। সেই হোটেল ষ্টাফ জানালো, এই খেলার জন্য আমরা সেই হিমালয়ের কোলে বিখ্যাত ষ্টেডিয়াম দেখতে পারবে না। ষ্টেডিয়াম সাধারনের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। যাইহোক, ধরমশালাতে আমার প্রধান আকর্ষন ছিল দলাই লামার গুম্ফা দেখা। সেদিন রাতে হোটেলের ছাদ থেকে দেখতে পেলাম ষ্টেডিয়ামে বড়বড় লাইট জ্বলছে। আন্তর্জাতিক ম্যাচের আগে লাইট পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে বলে হোটেলের কর্মচারীরা জানালেন। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই রওনা দিলাম গুম্ফার উদ্দেশ্যে।
কিছুটা গাড়িতে গিয়ে বাকি রাস্তা হেঁটেই উঠতে হয়েছিল। রাস্তা প্রচন্ড চড়াই হওয়াতে উঠতে যথেষ্ট কষ্ট হচ্ছিল। গুম্ফায় ঢোকার আগেই বিভিন্ন পোষ্টার দৃষ্টি টেনে নিলো। সেখানে লেখাগুলি পড়ে জানতে পারলাম, তিব্বতে চিনা সেনারা কিভাবে তিব্বতিদের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে। এটা জানতাম, তিব্বত দখল করার জন্য চিনাদের অত্যাচারে দলাই লামাকেও গুপ্ত পথে ভারতে এসে শরনার্থীর আশ্রয় নিতে হয়েছে। ভারত সরকার তিব্বতিদের শরনার্থীর মর্যাদা দিয়েছে। ছবির বিভৎসতা চিনা সেনাদের প্রতি ঘেন্না তৈরি হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। এরপর আমরা মুল গুম্ফার ভিতরে ঢুকলাম। সেখানে প্রচুর বৌদ্ধ সন্ন্যাসী যে যার নিজের কাজ করে যাচ্ছেন। চারপাশে অদ্ভুত নিঃশব্দতা। আমরা গেলাম সেই মূল বৌদ্ধমূর্তির সামনে। সোনার পাত দিয়ে মোড়া ধ্যানমগ্ন বৌদ্ধমুর্তির সামনে দাঁড়িয়ে নজরে এলো চারধারে আলমারিতে রাখা রয়েছে অজস্র ছোটবড়ো কিম্ভুত কিমাকার সব মূর্তি। জানতাম, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বিভিন্ন ধরনের মূর্তিতে বিশ্বাস করেন।
পাশের আলমারিতে দেখলাম কাপড়ে মোড়া ছোট কাঠের তক্তার মতো জিনিষ যত্ন করে রাখা রয়েছে। জোরে শব্দ করা বারন, কিন্ত কৌতুহল না রাখতে পেরে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞেস করে জানলাম সেগুলো সব প্রাচীন পুঁথি। প্রাচীন পুঁথির যে কি মাহাত্ম্য, সেটা অনেকেই জানেন। সন্ন্যাসীরা এতটাই কম কথা বলেন, যে এর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাইনি। দেখলাম দেওয়ালে আঁকা রয়েছে জাতকের নানা কাহিনীর অনুকরনে হাতে আঁকা ছবি। তবে একটা হলুদ কাপড়ে ঢাকা দেওয়া জায়গা, তার সামনে রাখা পাত্রে তাজা ফল রাখা রয়েছে দেখে একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, ওটা দলাই লামার বসার চেয়ার। সেটাকে নিয়মিত পূজো করা হয়। আরও ঘর ঘুরে প্রচুর বৌদ্ধ মূর্তি দেখে বাইরে উঠোন মতো জায়গায় এসে দেখি, ছোটছোট লামাদের বড়রা হাতে তালি দিয়ে কিছু প্র্যাকটিস করাচ্ছেন। বিষয়টি বুঝতে পারলেম না। দেখলাম এক বৃদ্ধ লামা হাতে জপযন্ত্র নিতে আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছেন।
তাঁকে অনুরোধ করে এক বহুল প্রচলিত বৌদ্ধ মন্ত্র বলে জপযন্ত্রটা হাতে পেলাম। রূপোর তৈরি সেই জপযন্ত্র ঘুরিয়ে প্রচণ্ড আনন্দ হয়েছিল। মূল গুম্ফার বাইরে বিশাল বাগান। সেখানে প্রচুর বিদেশি রয়েছেন। তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ জমালাম। গল্প করে বেশ কিছুক্ষন কাটলো। এরমধ্যে টের পেলাম বুক পকেটে রাখা মোবাইল ফোন কাঁপছে। দেখলাম আমাদের গাড়ির ড্রাইভার ফোন করে তাগাদা দিচ্ছেন, এরবেশি সময় এখানে দিলে যে পরের গন্তব্যে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে।