ঘুরে আসতে পারেন উড়িষ্যার কাশ্মীর –দারিংবাড়ি

Social

 শুভব্রত ঠাকুর : দৈনন্দিন জীবনধারণকে একটু বৈচিত্রের স্বাদ দিতে, পরিবার নিয়ে দিন কয়েক কাটিয়ে এলাম কাছাকাছি কিন্তু একটু দূরে.. না.. না.. দি পু দা (দিঘা-পুরী-দার্জিলিং) নয়…!

এবার আমাদের ভ্রমনসঙ্গী হয়েছিল ঝুমা(বোন), সৃজা(ভাগ্নী) ও বাল্যবন্ধু তথা ভগ্নিপতি সায়ণ। শুয়ে-বসে, গল্প-গুজবে বেশ কাটালাম ক’টাদিন, অরণ্য ছাওয়া পাহাড়ি উপত্যকা দারিংবাড়ি ও বেলাভূমি গোপালপুরে.. বৃষ্টিভেজা নিরিবিলিতে!

ভ্রমন পিপাসুদের কাছে, ঘুরতে বেরিয়ে যাতায়াত বা থাকা-খাওয়ার ‘কু’ বা ‘সু’ব্যবস্থা কোনোকালেই খুব একটা প্রাধান্য পায় না! সুতরাং শেষমুহূর্তের ব্যবস্থাপনায় শালিমার-তিরুবন্তপুরম এক্সপ্রেসের সাধারণ স্লিপার কামরায় কোনোমতে ছটি বার্থ দখল (সরকারি ভাবে) এবং লাগোয়া বাথরুমের ‘সুবাস(!!)’ সহযোগে, আমাদের যাত্রা হয়েছিল শুরু!

উড়িষ্যার পূর্বপ্রান্তে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত কন্ধমল জেলার একটি পার্বত্য উপত্যকা হল দারিংবাড়ি। আবহাওয়ার অনেকটা মিল থাকায় এই অঞ্চল আবার উড়িষ্যার কাশ্মীর বলেও পরিচিত!

ওড়িয়া ভাষায় বাডি/বাড়ি শব্দের অর্থ হল গ্রাম বা অঞ্চল। ব্রিটিশ আমলে এই অঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন ড্যারিং সাহেব। ধারণা করা হয়, তাঁর নামেই এই অঞ্চলের নাম লোকমুখে হয়ে ওঠে দারিংবাড়ি!

আদিবাসী অধ্যুষিত অদ্ভুত সুন্দর এই পাহাড়ী রেইন ফরেস্ট-এর প্রধান আকর্ষণ হল বিস্তীর্ন পাইন জঙ্গল ঘেরা প্রাকৃতিক সবুজ উপত্যকা। আশেপাশের কফি-বাগিচা, মশলা (হলুদ ও গোলমরিচ) ক্ষেত, ছোট ছোট পাহাড়ী নদী ও ঝর্ণার উপস্থিতিতে দারিংবাড়ি এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য্যের আবেশ সৃষ্টি করে।

আশেপাশে (১০-১৫ কিমি) ঘুরে দেখা যেতে পারে দাসিংবাড়ি (মেদুবান্দা) জলপ্রপাত, দাদুবাদা প্যারাডাইস (লাভার্স পয়েন্ট), সাইলেন্ট ভ্যালী (পাইন বন), কফি ও স্পাইস গার্ডেন, ডুলুরী নদী, নেচার পার্ক, বাটারফ্লাই পার্ক, হিলভিউ পার্ক, এমু বার্ড জু। আবার যাওয়া যেতে পারে একটু দূরের (১৩০-১৫০ কিমি) পুলবনি’র পুটুডি জলপ্রপাত, কোটাগড়ের পক্ষীনিবাস বা লুডু জলপ্রপাত অথবা বেলঘর অভয়ারণ্য।

দারিংবাড়ি তে দু’রাত কাটিয়ে অতঃপর সবাই রওনা দিলাম সমুদ্রবন্দর ও বেলাভূমি গোপালপুরে উদ্দেশ্যে, ১১৫-১৪০ কিমি পথ উজিয়ে আরো কিছু জায়গা ঘুরে।

হরভাঙ্গি জলাধার:

গজপতি জেলার আবাদা’র কাছে হরভাঙ্গি নদীর ওপর ৬৯০ মিটার লম্বা ও ৫০ মিটার উচ্চতার এই হরভাঙ্গি ড্যাম তৈরি হয় ১৯৯৮ সালে। ড্যামের ওপর দিয়ে বয়ে চলা ঠান্ডা হওয়া যেন রোদে ভাজা ভাজা মনটাকেও জলাধারের জলের মতোই স্বচ্ছ ও শীতল করে তুলল!

চন্দ্রগিরি:

ক্রান্তীয় সবুজ বনানীর প্রাচুর্য, খাঁড়া পাহাড়ের ঢাল, চড়াই উৎরাই, তির তির করে বয়ে চলা ছোট ছোট পাহাড়ী নদী, ছবির মতো ল্যান্ডস্কেপসম সবুজ উপত্যকাময় চন্দ্রগিরি। গজপতি জেলার এক ছোট্ট শহর… নিজস্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর! এই চন্দ্রগিরিকে আবার সহজেই ‘মিনি তিব্বত’ নামেও অভিহিত করা যায়! কারন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও চন্দ্রগিরি বিখ্যাত ওখানে অবস্থিত বেশকিছু তিব্বতি মনাস্ট্রি বা বৌদ্ধবিহার এর জন্য!

বৌদ্ধ ধর্মগুরু দলাই লামার অনুগামী হয়ে ভারতে চলে আসা অসংখ্য তিব্বতি শরণার্থীরা যখন সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েন এবং চন্দ্রগিরিও তখন থেকে এক তিব্বতিপ্রধান অঞ্চল হয়ে ওঠে। ১৯৫৯ সালে সেখানে স্থাপিত হয় এক বৌদ্ধবিহার। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে এই বৌদ্ধবিহার সম্প্রসারণের উদ্দেশ্য ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন এবং ২০১০ সালে সম্প্রসারিত ও পুনর্নির্মিত এই বিশাল ‘থুপতেন মিনদ্রোলিং মনাস্ট্রি’ উদ্বোধন করেন স্বয়ং দলাই লামা। এই বিহারটি ‘পদ্মনাভন বৌদ্ধবিহার’ নামেও পরিচিত।
এই বৌদ্ধবিহারের পাঁচ কিমির মধ্যেই আছে আর এক অসাধারণ গনদাহাটি (খাসাদা) জলপ্রপাত।

     

         তপ্তপানি:

দারিংবাড়ি থেকে ১২০ আর ব্রহ্মপুর থেকে ৬০ কিমি দূরত্বে গঞ্জাম জেলায় অবস্থিত তপ্তপানি বিখ্যাত তার সালফার যুক্ত প্রাকৃতিক উষ্ণ প্রস্রবণ এর জন্য। এই প্রস্রবণ এর স্পর্শে নাকি সমস্ত রকমের চর্মরোগ নিরাময় হয়! তপ্ত (গরম) পানি (জল) থেকেই এই জায়গার নাম তপ্তপানি। মন্দির প্রাঙ্গনে অবস্থিত এই প্রস্রবণ দেখে…. গ্রামের দীঘি বা পুকুরে স্নানরত স্থানীয় আদিবাসীদের একটা সুন্দর ছবি ফুটে উঠল! তবে সেটা ছবি হিসাবেই ভালো লাগার… দীর্ঘ যাত্রাপথের ক্লান্তি ভুলতে গরম জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা তখন আর আরামদায়ক না হয়ে, বিরক্তিকর বা গা ঘিমঘিনানির পর্যায়ে পৌঁছানো টা কেবল কয়েক লহমা মাত্র!তবে তপ্তপানিকে মন্দির শহরও বলা চলে। চারদিকে অসংখ্য ছোট বড় নানান মন্দির যেমন নীলকন্ঠেশ্বর মন্দির, কন্দিমাতা মন্দির ইত্যাদি। তবে সব থেকে আকর্ষক সম্ভবত পাহাড় চুড়ায় অবস্থিত মাহুরী কালুয়া মন্দির, টিলা শীর্ষে দাঁড়িয়ে চারপাশের নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য….!