ম্যানগ্রোভ অরণ্যে সুন্দরবন ভ্রমণে যেতে চান ? জেনে নিন বিস্তারিত …

Social

শুভ্রাংশু দাশগুপ্ত: কথায় আছে ‘জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ’। যেমন সুন্দর, তেমনই বিপদ সঙ্কুল এ অরণ্য। যা স্বনামধন্য রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারদের বাসভূমি। যেখানে নদী নালা ও নোনতা জলের খাঁড়িতে গিজগিজ করে কুমির। সাথে অজস্র বিষধর সাপের অবাধ বিচরণ। এহেন নানান বিপদের সাথে মোকাবিলা করে বাদাবনে প্রতিনিয়ত রচিত হয় মানুষের জীবন সংগ্রামের কাহিনি। বিপদের ঝুঁকি নিয়ে জীবিকার তাগিদে স্থানীয় মানুষের জঙ্গল থেকে মধু সংগ্রহ, কাঁকড়া ধরা অথবা মাছ ধরা। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন ।

বিপদের কথা বাদ দিলে, জল-জঙ্গলের অসাধারণ বৈশিষ্ট্যময় প্রকৃতি ও জীব-জন্তুর সমাহারে যা প্রকৃতি প্রেমী ও পর্যটকদের কাছে এক স্বর্গরাজ্য। দুপাশে সবুজ ম্যানগ্রোভের জঙ্গলের মাঝে নোনতা জলের খাঁড়ির মধ্যে দিয়ে লঞ্চে করে ভেসে যেতে যেতে ও গাইড তপন বাবুর বর্ণিত নানান ঘটনা শুনতে শুনতে এসব কথাই ভাবছিলাম। শীতের শেষের মনোরম আবহাওয়ায় ফুরফুরে মেজাজে জঙ্গলের কোর এলাকার মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে সারাদিন জঙ্গলের প্রকৃতিকে উপভোগ ও উপলব্ধি করা আর উৎকন্ঠা ও উত্তেজনা নিয়ে দুপাশের জঙ্গলের পানে ঠায় চেয়ে থাকা, যদি তেনার দর্শন পাওয়া যায়।

অনেক হিল্লি দিল্লি ঘুরে বেড়ালেও এর আগে কখনো সুন্দরবনের অন্দরে যাওয়া হয় নি। তাই এই মরসুমে আর মিস করা যাবে না এই পণ নিয়ে ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমেই প্রথম পরিচয় হওয়া এক প্রিয় দাদার সাথে সুন্দরবন ট্রিপের প্ল্যান করে ফেলি। কিন্তু অফিসের চাপে শুক্রবারের ছুটি বাতিল হওয়ায় যাওয়াও ক্যানসেল। শুক্রবার সারাদিন মন খারাপ নিয়ে অফিস করে বাড়ি ফেরার পর সেই দাদার আপলোড করা ছবি দেখে জেদটা চেপে গেল, সেই সাথে আইডিয়াও। ঠিক করে ফেললাম এই উইকএন্ডেই যাব সুন্দরবন, অন্যরুটে ঝড়খালি হয়ে। কোনো ছুটি না নিয়েই। শনি-রবি দুদিনের ঝটিকা সফর। তবু দুধের স্বাদ তো ঘোলে মিটবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। শনিবার সকালে বেরিয়ে গাড়িতে করে সাড়ে ৩ ঘন্টায় সোজা পৌঁছলাম ঝড়খালি । সুন্দরবনের কোর এলাকার জঙ্গলের বাইরে নদীর অপর পারে অবস্থিত একটি বড় গ্রাম ঝড়খালি। চারদিক দিয়ে জলে ঘেরা একফালি ভুখন্ড। কয়েকবছর হল বাসন্তীতে নদীর উপর ব্রীজ হওয়ায় মূল ভুখন্ডের সাথে সড়ক পথে যোগ হয়েছে। সুন্দরবন ট্যুরের প্রচলিত রুটটি হল সোনাখালি বা গদখালি থেকে জলপথে পাখিরালয় পৌঁছে, পরদিন সজনেখালি থেকে পারমিশন নিয়ে কোর এলাকায় প্রবেশ। আর দ্বিতীয় আরেকটি রুট হল সড়কপথে এই ঝড়খালি পোঁছে সেখান থেকে সরাসরি পারমিশন নিয়ে কোর এলাকায় প্রবেশ। বছর তিনেক হল সজনেখালির পাশাপাশি ঝড়খালি থেকেও জঙ্গলে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া চালু হয়েছে। সোনাখালি বা গদখালি, কোর এরিয়ার উত্তরদিকে। আর আরো দক্ষিণে অনেকটা নেমে হল ঝড়খালি।

           ঝড়খালির কথাঃ
ঝড়খালিতে আমাদের থাকার আস্তানা ‘আরণ্যক হোম স্টে’। আগের দিন রাতে কথা বলে রেখেছিলাম। শান্ত পরিবেশে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে হোম স্টে। বাড়ির মালিক পরিতোষ মন্ডল ও তাঁর ছেলের ভাল ব্যবহারে ও হোম স্টের পরিবেশ দেখে প্রথমেই বেশ ভাল লেগে গেল। রাস্তার দিকে পাকা বাড়িতে তিনটি ঘর পর্যটকদের থাকার জন্য। সাদামাটা ব্যবস্থা। ভিতরে রয়েছে পুকুর, কিছু গাছপালা, ছোট্ট চাষের খেত আর পিছন দিকে মন্ডল পরিবারের থাকার জন্য কাঁচা ঘর। রাস্তার ওপারে একটি ভেড়ি। একেবারে নির্মল গ্রাম্য প্রকৃতি। আশেপাশে অনেক পাখির ডাক। ঘুঘু, শালিক, টিয়া ছাড়াও রয়েছে মোহনচূড়া ও বাঁশপাতিরা। ভাত, ডাল, কুচো চিংড়ি দিয়ে বাঁধাকপি ও নদী থেকে ধরা টাটকা কান মাছের ঝোল দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে খানিক বিশ্রামের পর চললাম ঝড়খালির ম্যানগ্রোভ পার্ক ও জেটিঘাটে। পরদিন কোর এরিয়ায় ভ্রমণের জন্য বোট বুক করতে হবে জেটিঘাট থেকে। ঝড়খালির তিনদিকে তিনটি নদী – মাতলা, বিদ্যাধরী ও দুই নদীর সংযোগকারী হেড়োভাঙ্গা। পার্ক ও জেটি ঘাট দুইই হেড়োভাঙ্গা নদীর ধারে, হোম স্টে থেকে ১০ মিনিটের রাস্তা।
১০০ একর জুড়ে ঝড়খালির ম্যানগ্রোভ পার্ক ও টাইগার রেস্কিউ সেন্টার। যার মূল আকর্ষণ দুটি বিশাল সাইজের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। বেশিরভাগ পর্যটক, যাদের জঙ্গলে খোলা বাঘ দেখার সৌভাগ্য বা দূর্ভাগ্য হয় না, তাদের জন্য রয়েছে জালে ঘেরা এই দুটি বাঘ। জাল দিয়ে ঘেরা হলেও ন্যাচারাল হ্যাবিট্যাটে রাখা হয়েছে এদের। বাঘ ছাড়াও এখানে রয়েছে বেশ কিছু কুমির। খালের মত জলধারার পাড়ে রোদ পোহাচ্ছিল গোটা চারেক কুমির। চোখে পড়ল একটি গোসাপ বা Monitor Lizard। পার্কের বড় গাছগুলিতে অনেক পাখি। বাগানের একটা অংশে প্রজাপতিদের মেলা। ঝড়ে ক্ষতি গ্রস্থ হয়ে আপাতত বন্ধ ওয়াচ টাওয়ারটি।
এরপর চললাম নদীর পাড়ে। জেটিঘাটে সার বাঁধা বিভিন্ন রকম লঞ্চ ও বোট দাঁড়িয়ে। কথাবার্তা বলে এখানেই কালকের সারাদিনের জন্য একটি 4 Cylinder বোট ঠিক করে নিলাম ৫০০০ টাকায়। ফরেস্টের প্রবেশ মূল্য ও গাইড চার্জ অবশ্য অতিরিক্ত। নদীর ওপারে তখন অস্তমিত সূর্য। জেটিঘাটে বোট গুলোর ফিরে আসা ও ছেড়ে যাওয়ার ব্যস্ততা বিকেল বেলায়। সুন্দরবনের সূর্যাস্ত সত্যিই মোহময়ী। আকাশে ও জলে যেন রঙের খেলা। সন্ধ্যের পর আন্ধকার হাতড়ে ফিরে আসা হোমস্টেতে। নিঝুম অন্ধকারে ঢাকা গ্রাম। দূষণ হীন পরিস্কার আকাশে অজস্র তারা। একটু দূরে এক জায়গায় কিছু আলো দেখে জানতে চাওয়ায় শুনলাম যে ওদিকে নাকি একটা বড় রিসর্ট ও হেলিপ্যাড নির্মাণের প্রকল্প চলছে। যদিও পরে শুনেছিলাম পরিবেশ দপ্তরের আপত্তিতে হেলিপ্যাড নির্মাণের কাজ স্থগিত রয়েছে।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল অসংখ্য পাখির কিচির মিচিরে। লুচি তরকারি দিয়ে প্রাতরাশ সেরে চললাম টোটো ধরে জেটিঘাটের দিকে। আজ যে সুন্দরবনের অন্দরে যাত্রা। স্বভাবতই বেশ উত্তেজিত সকলে। এই সকাল সকাল মন্ডল পরিবার আমাদের জন্য দুপুরের খাবার বানিয়ে বেঁধে ছেদে দিয়ে দিয়েছে, যাতে লঞ্চে আমরা খেয়ে নিতে পারি। আমাদের জন্য জেটি ঘাটের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন বোট মালিক শ্যামল মন্ডল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির সাথে আলাপ করিয়ে দিয়ে জানালেন তিনিই আজ আমাদের গাইড, তপন মিস্ত্রি।

             জলবিহারে সুন্দরবনঃ
সাড়ে আটটা বাজল বোট ছাড়তে। আমরা ৪ জন ও ড্রাইভার – মাত্র এই ক’জন যাত্রীর তুলনায় বোট বা লঞ্চটি বিশাল। দোতলার উপরের ডেকে চেয়ার টেবিল পাতা। নিচের তলায় শোয়ার খাট বিছানা পাতা। রয়েছে টয়লেট, রান্নার জায়গা সব। গাইড ছাড়া আমাদের সাথে বোট চালক শেখর ও তার সহযোগী সঞ্জয়। বেশ একটা রাজকীয় ফিলিং হচ্ছিল নদীর মধ্যে দিয়ে এত বড় বোটে ভাসতে ভাসতে। নদীর ওপারে ম্যানগ্রোভের জঙ্গল জাল দিয়ে ঘেরা। যাতে বাঘ সাঁতার কেটে এপারের লোকালয়ে না চলে আসতে পারে তার জন্য এই জালের ব্যবস্থা হয়েছে কয়েক বছর হল। নদীর ধারে হেতাল গাছের সারি, যা নাকি বাঘের থাকার বেশ পছন্দের জায়গা। জলে বক ও পানকৌড়ি। প্রায় আধ ঘন্টা হেড়োভাঙ্গা নদীতে চলার পর এসে পড়লাম বিশাল চওড়া একটা জায়গায়, যেখানে হেড়োভাঙ্গা, বিদ্যাধরী নদীতে মিশেছে। পঞ্চমুখানি – বিদ্যাধরীর দুটো মুখ, হেড়োভাঙ্গা, দো বাঁকি ও জাহাজ ফেঞ্চি এই পাঁচ ধারার মিলন স্থল। এতটাই চওড়া, যে এপার ওপার কিছুই দেখা যায় না। বোট চালক শেখর জানাল, যে মার্চের পর যখন নদী উত্তাল হয়ে ওঠে তখন এই পঞ্চমুখানির সঙ্গম স্থলে বোট চালানো বেশ কষ্টকর হয়ে ওঠে। দো বাঁকির খাড়িতে ঢুকে পাড়ে রোদ পোহানো কুমির চোখে পড়ল এদিন প্রথমবারের জন্য।
নামলাম ‘দোবাঁকি (Do banki) ক্যাম্পে’। কোর এরিয়ার মধ্যে জাল দিয়ে ঘেরা ৭০০ মিটার দীর্ঘ এলিভেটেড বাঁধানো পথ নিচের ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের উপর দিয়ে। সুন্দরী, গরান, গেঁওয়া, হেতাল, কেওড়া, খোলসে সব রকম ম্যানগ্রোভ গাছের সম্ভার দো বাঁকিতে। গাছ চেনাচ্ছিলেন তপন বাবু। একসময় এখানে অনেক হরিণ রাখা হয়েছিল জালের ভিতরে। এখন তা ছেড়ে দেওয়ায় এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। ওয়াচ টাওয়ারের নিচে মিস্টি জলের জলাশয়, যাতে জন্তু জানোয়ারেরা জল খেতে এলে উপর থেকে দেখা যায়। জলাশয়ে শতাধিক পরিযায়ী পাখি, যার মধ্যে বেশিরভাগ ‘Lesser Whisting Duck’ বা সরাল। আমাদের ওয়াচ টাওয়ারের উপর থাকাকালীন বাঘ বা হরিণ কেউই এল না জল খেতে, তবে জলের পারে দেখা মিলল কুমিরের মত দেখতে একটা অদ্ভুত সরীসৃপ। গাইডের বলা নাম ‘ঘোড়েল’। একে গুই সাপ বা Water Monitor ও বলে। ডাঙা থেকে জলে নেমে সে সাপের মত কিলবিল করে সাঁতার কেটে পাড়ে বসে থাকা কয়েকটা সরালের দিকে এগোতে থাকল। বোধহ্য় খাবার মতলবে ছিল। কিন্তু সজাগ পাখি গুলো ঘোড়েল কাছে যেতেই উড়ে পালালো। প্রকৃতির জীব জগতের মধ্যে খাদ্য খাদকের এক লড়াই চোখের সামনে। ফেরার সময় জঙ্গলের আড়ালে একটি হরিণের দেখা মিলল। এই ক্যাম্পে আছে একটি বন বিবির মন্দির। বাঘেদের দেশে পুজিত হন বন বিবি ও দক্ষিণ রায়।

         খাঁড়ি পথে জঙ্গল দর্শনঃ
আবার বোটে করে ভেসে পড়া। এবার খাঁড়ির পথে। চওড়া নদীর থেকে অপেক্ষাকৃত সরু খাঁড়ি পথে নৌ বিহার জঙ্গল ভ্রমণে বেশি চিত্তাকর্ষক। কারণ গা ছমছমে জঙ্গলের সান্নিদ্ধ্য ও পশুপাখি দেখার সম্ভাবনা বেশি। তাই ঠিক হয়েছিল একদিনের ট্রিপে নদী পথে সুধন্যখালি, সজনেখালি সব কিছু না গিয়ে, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে খাঁড়ির পথে অনেকখানি চলে শুধু সুধন্যখালি দেখা, যাতে জঙ্গলকে ভালভাবে উপলব্ধি করা যায়। গাজিখালি, পীরগাজি ইত্যাদি নানান খাঁড়ি হয়ে পড়লাম বনবিবি ভরানী নামক খাঁড়িতে। সংকীর্ণ খাঁড়ির দু ধারের জঙ্গল বেশ গা ছম ছমে লাগছিল। পুরো পথেই দু পাড়ে মাঝে মধ্যেই রোদ পোহাতে থাকা কুমির, জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা হরিণ, বন শুয়োর বা গাছে গাছে দু একটা মাছরাঙা চোখে পড়ছিল। ততবুও রবিবার হওয়ায় পর্যটক বোঝাই প্রচুর সংখ্যক বোট চলাচল করায়, হৈ হল্লা ও শব্দের ফলেই হয়তো পাখি অপেক্ষাকৃত কম এদিন। খাঁড়ির শেষে পড়লাম মেটে নদীতে। বেশ চওড়া। গঙ্গা, দামোদর বা অন্যান্য নদীর সাথে সুন্দরবনের নদীর পার্থক্য হল যে, সাধারণত সব নদীই পাহাড়ের হিমবাহ, লেক বা বৃষ্টির জলে উৎপন্ন হয়ে সমুদ্রে গিয়ে মেশে, আর মাতলা, বিদ্যাধরীর মত সুন্দরবনের নদীগুলি সমুদ্র থেকেই উৎপন্ন হয়ে ডাঙার কছুটা ভিতরে গিয়ে শেষ হয়। এ সব নোনতা জলের নদী। মেটে নদীতে মিনিট কুড়ি চলে আবার প্রবেশ করলাম খাঁড়িতে। সুধন্যখালির খাঁড়ি। সুধন্যখালি ক্যাম্পের বাইরে জলের মাঝে নোঙর করা হল, লাঞ্চের জন্য। ডেকে চেয়ার টেবিল পেতে চারপাশের জঙ্গল দেখতে দেখতে দারুণ স্বাদের ভাঙ্গান মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়া, অনেক দিন মনে থাকবে।

                   সুধন্যখালিঃ
এবার নামা হল ‘সুধন্যখালি (Sudhanyakhali) ক্যাম্পে’। ব্যাঘ্র প্রকল্পের কোর এরিয়ার ভিতরে খানিকটা জায়গা জাল দিয়ে ঘিরে তৈরি হয়েছে ক্যাম্প। রয়েছে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অফিস, স্টাফ কোয়ার্টার, বন বিবির মন্দির ও ওয়াচ টাওয়ার। সুন্দরবন ভ্রমণে পুরোটাই জল বিহারে ঘোরা, শুধু মাত্র এই দু তিনটি ক্যাম্পেই জঙ্গলে নামতে পার্মিশন দেওয়া হয়। আশেপাশে অনেক বাঁদর ও হনুমান। এখানে সাম্প্রতিক কালে কবে কবে বাঘ দেখা গিয়েছিল, তার রেকর্ড রাখা আছে একটি বোর্ডে। শেষ দেখা গিয়েছিল জানুয়ারী মাসে, ৩ সপ্তাহ আগে। ওয়াচ টাওয়ারের উপর উঠে সামনে জঙ্গলের ল্যান্ডস্কেপ দেখে মন ভরে গেল। নিচে এখানেও একটি মিস্টি জলের জলাশয় রয়েছে, যেখানে পশুরা জল খেতে আসে। তার ওপাশে গা ছম ছমে জঙ্গল ও মাঝে মাঝে এক ফালি করে তিনটি খোলা প্রান্তর। অসাধারণ সৌন্দর্য্য জঙ্গলের। একটু দূরে খোলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি বেশ বড় পাখি। নাম ‘মদন টাক’ বা Lesser Adjutant Stork। সুন্দরবনের সব চেয়ে বড় পাখি। সারস প্রজাতির। দেখলে মনে হয় যেন মাথায় কয়েক গাছা চুল ওয়ালা টাক। সে কারণেই অমন নাম। হঠাৎ ওপাশের জঙ্গল থেকে খোলা এক ফালি প্রান্তরে বেরিয়ে এল একটা হরিণ। কাছাকাছি অন্য জন্তুর উপস্থিতি টের পেয়েই, প্রায় ১৫-২০ কেজি ওজনের ভারী শরীর নিয়ে দু দিকে উড়ে গেল দুটি পাখি। হরিণ একবার ঘাড় ঘুরিয়ে যেন আমাদের দিকে দেখে নিয়ে আবার পরের জঙ্গলের দিকে এগিয়ে চলল। গাইড বললেন যেখানে হরিণ থাকে, তার আশেপাশে বাঘ থাকার সম্ভাবনা। তবে কি ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম বাঘের সাইটিংটা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে? রুদ্ধ শ্বাসে চেয়ে থাকা। এদিকে নিচের জলাশয়ে মাছরাঙা, ফিঙে ও বকের মাছ ধরার খেলা। এখানেও জলের পাড়ে রোদ পোহাচ্ছে একটি ঘোড়েল। আবার আরকেটি জলে সাঁতার কেটে এগিয়ে এল জলে থাকা বকের দিকে। হরিণটি ততক্ষণে জঙ্গলের সব কটা ফালি পেরিয়ে চলে এল জলের পাড়ে। যেই না জল খেতে যাবে অমনি ওয়াচ টাওয়ারে ওঠা অতি উতসাহী কিছু পর্যটকের চেচামিচিতে ভয় পেয়ে জঙ্গলে পগাড়পার বেচারা। ওয়াচ টাওয়ারের উপর আরো অনেকক্ষণ বসে থাকতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু গাইড জানালেন যাবার সময় হয়ে গেছে। কোর এরিয়া থেকে বিকেল ৪টের মধ্যে বেরিয়ে পড়া নিয়ম। এখান থেকে ঝড়খালি আরো আড়াই ঘন্টার পথ। অবশ্য এমন দায়িত্ব জ্ঞ্যানহীন পর্যটকের দল এলে এমনিই জন্তুরা ভয়ে কম আসবে। অতএব ফেরার পালা।
খাঁড়ির শেষে পড়লাম বিদ্যাধরী নদীতে। বিশাল চওড়া হতে থাকা নদীতে ঘন্টা দেড়েকের যাত্রা। তারপর আবার পঞ্চমুখানির সঙ্গম পেরিয়ে হেড়োভাঙ্গা নদীতে প্রবেশ। বিকেলবেলা নদীতে চোখে পড়ছে অনেক মাছ ধরা দেশি নৌকা। দু একটি নৌকা আমাদের বোটের কাছে এসে মাছ বিক্রি করতে চাইছিল। এদিনও সুন্দরবনের অসাধারণ সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ হল, নদী পথে চলতে চলতে। সূর্যাস্তে প্রকৃতি যেন আবির খেলায় মেতে উঠে আকাশ ও জলকে রাঙিয়ে দেয়। বিকেল প্রায় সাড়ে ৫ টার সময় অবশেষে ফিরে এলাম ঝড়খালির ঘাটে। একটা মনে রাখার মত দিন কাটল সুন্দরবনের জল-জঙ্গলে। বোট মালিক শ্যামল মণ্ডল ও গাইড তপন মিস্ত্রি এদিনের পুরো সফরে আমাদের ভাল ভাবে গাইড করেছিলেন। জল বিহারে সুন্দরবন ভ্রমণের এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা নিয়ে, ঝড়খালির মানুষদের বিদায় জানিয়ে ঘরে ফেরার পালা। দু দিনের সফরে হয়ত দেখা হল বিশাল সুন্দরবনের মাত্র একটুকরো। কিন্তু জল-জঙ্গলের যে স্বাদ পেলাম, বার বার সুন্দরবনের প্রকৃতি ও মানুষগুলোর কাছে ফিরে আসার জন্য তা অনুপ্রাণিত করবে।

-:প্রয়োজনীয় তথ্যঃ:-
যাতায়াতঃ কলকাতা থেকে ঝড়খালি ১১৭ কিমি (বিধাননগর অঞ্চল থেকে)। বাসন্তী হাইওয়ে হয়ে গাড়িতে সময় নেয় সাড়ে ৩ ঘন্টা। এছাড়া লোকাল ট্রেনে ক্যানিং গিয়ে সেখান থেকে ম্যাজিক ধরে দেড় ঘন্টায় যাওয়া যায় ঝড়খালি।
ঘোরার ব্যবস্থাঃ ঝড়খালি থেকে সারাদিনের জন্য বোট ভাড়া – 2 Cylinder Boat ৪০০০ টাকা, 4 Cylinder Boat ৫০০০-৫৫০০টাকা। এছাড়া জঙ্গলে প্রবেশ মূল্য জন প্রতি ১০০, বোটের ৫০০ ও গাইড চার্জ ৫০০ টাকা। অনেকে মিলে গেলে সাশ্রয় হয়। 4 cylinder Boat এ অনায়াসে ২০-২৫ জন যেতে পারে। চাইলে জিনিস পত্র কিনে নিয়ে বোটে রান্না করে খাওয়া যায়। কুক নিলে চার্জ ৬০০ টাকা।
যদি কেউ নিজেরা ট্যুর প্ল্যান করে যেতে চায় তার জন্যঃ বোটের জন্য যোগাযোগ – শ্যামল মন্ডল – 9732163241। গাইড তপন মিস্ত্রি – 9735229338.
থাকার জায়গাঃ ঝড়খালি তে আমরা ছিলাম ‘আরণ্যক হোম স্টে’। ঘর ভাড়া ৭০০ টাকা। যোগাযোগ – ৮৫০৯৫১০৯৭৮
এছাড়াও থাকার জন্য আছে বেশ কয়েকটি হোম স্টে, লজ ও রিসর্ট; যেমন: সুন্দর রিসর্ট, আকাশ হোমস্টে , ম্যানগ্রোভ নেস্ট হোমস্টে ,রয়েল সুন্দরবন ওয়ার্ল্ড রিসর্ট .
ঝড়খালি ছাড়া পাখিরালয় দ্বীপে আছে অনেক থাকার ব্যবস্থা। সোনাখালি বা গদখালি থেকে যেতে হয় পাখিরালয়।

পর্যটকদের কাছে আবেদন:
সুন্দরবনে যান জঙ্গলকে ভালবেসে, প্রকৃতিকে উপভোগ করতে। কোনোপ্রকার দূষণ তো নয়ই, লঞ্চে চড়ে মদ খেয়ে হল্লাবাজি করার জায়গাও সুন্দরবন নয়। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ এর মর্যাদা প্রাপ্ত সুন্দরবন কিন্তু আমাদের গর্বের। তাই জঙ্গলের পরিবেশ, বন্য প্রাণ, পাখি, স্থানীয় মানুষ বা প্রকৃতি প্রেমী পর্যটক যাতে কেউ অসুবিধায় না পড়ে, বিব্রত না হয়, সেদিকে সবার নজর দেওয়া উচিৎ।

ছবি: লেখক এর নিজস্ব

Leave a Reply