দেবু সিংহ,মালদা : ঘরে বসেই মহাকাশের রহস্য সন্ধান চালাচ্ছে ১২ বছরের ছেলেটি৷ এক বছর ধরে মহাকাশ তার অবসরের সঙ্গী৷ ইতিমধ্যেই গ্রহাণু, নক্ষত্রপুঞ্জ ও সুপারনোভা শনাক্তকরণে সাফল্যও পেয়েছে সে৷ খুদে শৌর্য এখন নাসা কিংবা ইসরোর মহাকাশ বিজ্ঞানীদের কাছে পরিচিত নাম৷ বাবা-মা চাইছেন, ভবিষ্যতে ছেলের শখের সঙ্গে যেন পেটের কোনও সংঘর্ষ না বাধে৷ নিজের খুশিকে আঁকড়ে ধরেই অন্নসংস্থান হোক ছেলের৷
পুরো নাম শৌর্য পাল৷ বাড়ি মালদা শহরের রিজেন্ট পার্কে৷ শহরের একটি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ক্লাস সেভেনের ছাত্র শৌর্যের বাবা শুভেন্দু পাল ও মা অর্পিতা পাল৷ দু’জনেই বাচ্চাদের প্রাথমিক শিক্ষাদান করেন৷ খুদেকাল থেকেই তাঁদের একমাত্র ছেলের আকাশ দেখার নেশা৷ বয়স যত বেড়েছে, নেশা ততই জাপটে ধরেছে ছেলেকে৷ মহাকাশ নিয়ে বই, ইউটিউব চ্যানেল ঘেঁটে সারা৷ ছেলের নেশাই তাঁদের খোঁজ দিয়েছে শোভন আচার্য নামে দিল্লিবাসী এক সিটিজেন সায়েন্টিস্টের৷ শোভনবাবুও মালদার ভূমিপুত্র৷ শৌর্যের নেশা দেখে তিনি তাকে ‘দ্য সিটিজেন সায়েন্টিস্ট’ নামে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে অ্যাড করে নেন৷ ওই গ্রুপে গোটা বিশ্বের বহু মহাকাশ চর্চারত মানুষ রয়েছেন৷ সেখান থেকেই শৌর্য মহাকাশ নিয়ে আরও জানে৷ পরবর্তীতে সে আইএএসসি নামে একটি বিদেশি সংস্থায় যোগ দেয়৷ এই সংস্থার সহকারী সংস্থা নাসা৷ আইএএসসি সংস্থার হয়েই মহাকাশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য গ্রহাণু, নক্ষত্রপুঞ্জ এবং সুপারনোভার অবস্থান চিহ্নিত করার প্রাথমিক কাজটি করে সে৷
শৌর্য জানাচ্ছে, “খুব ছোটতে বাবা-মায়ের সঙ্গে ছাদে গিয়ে আকাশ দেখতাম৷ একটু বড় হলে তারাদের ছবি তুলতাম৷ আকাশ আমাকে বড্ড টানে৷ কোন নক্ষত্র কেমন দেখতে, তার আলোর রং কেমন, এসব জানতে খুব ইচ্ছে হয়৷ এখন এসব নিয়ে খানিকটা জেনেছি৷ তাই একটা টেলিস্কোপ কিনতে খুব ইচ্ছে করে৷ তাহলে বাড়িতে বসেই আরও আকাশ দেখতে পারি৷ আমরা মূলত সিটিজেন সায়েন্স প্রোজেক্টে কাজ করি৷ আসলে ব্রহ্মাণ্ড এত বড় যে মহাকাশ বিজ্ঞানীদের সবসময় সব বিষয়ে নজর রাখা খুব সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়৷ তাই গোটা পৃথিবীতে যারা মহাকাশ চর্চায় আগ্রহী, তাঁদের এই কাজগুলি বিজ্ঞানীরা দিয়ে দেন৷ আমরা প্রাথমিকভাবে গ্রহাণু, নক্ষত্রপুঞ্জ, সুপারনোভাগুলি চিহ্নিত করি৷ মহাকাশ বিজ্ঞানীদের সেই তথ্য পাঠিয়ে সাহায্য করি৷ আমি মূলত গ্রহাণু, সুপারনোভা হান্টিং এবং গ্যালাক্সি ক্লাসিফিকেশনের কাজ করি৷ হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে থাকা প্যানস্টার ওয়ান ও টু নামে দুটি বড় টেলিস্কোপে তোলা ছবি আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়৷ সেই ছবি দেখেই আমরা নতুন খোঁজ চালাই৷ আর গ্যালাক্সি ক্লাসিফিকেশনের ক্ষেত্রে আমি নাওজ এবং পুনে নলেজ ক্লাস্টার নামে দুটি সংস্থার হয়ে কাজ করি৷ নাওজের হয়ে এক মাসে এক হাজার গ্যালাক্সি ক্লাসিফিকেশন করতে হবে৷ গোটা পৃথিবীতে ১১৮ জন সেই কাজ করতে পেরেছিলেন৷ তাঁদের মধ্যে আমিও একজন৷ ইতিমধ্যে আমি তিনটি নতুন গ্রহাণু শনাক্ত করেছি৷ একটি নতুন সুপারনোভারও খোঁজ পেয়েছি৷ আমি বড় হয়ে অ্যাস্ট্রোফিজিক্স নিয়ে পড়তে চাই৷”
শৌর্যের বাবা শুভেন্দুবাবু বলছেন, “ছেলে খুব কল্পনাবিলাসী৷ ছবি আঁকে, নতুন কিছু ভাবে৷ ছোট থেকেই আকাশ নিয়ে ওর ভীষণ কৌতুহল৷ একটু বড় হলে ও মহাকাশ নিয়ে আমাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে দিত৷ ওর কৌতুহল দেখে আমি ওকে মহাকাশ সম্পর্কিত বইপত্র এনে দিই৷ মুহূর্তের মধ্যে সেসব বই পড়া শেষ হয়ে যেত৷ এর মধ্যেই কোভিড চলে আসে৷ আমরা সবাই বাড়িতে বন্দি হয়ে যাই৷ তখনই শোভন আচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ হয়৷ তিনিও শৌর্যকে নিয়ে আগ্রহী হন৷ নিজের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে শৌর্যকে শামিল করে নেন৷ এরপর থেকেই ছেলে শোভনবাবুর গাইডেন্সে কাজ করছে৷ মহাকাশ চর্চা ওর নেশা৷ ক্লাস ফোরে পড়ার সময় ও নাসা কিডসে পৃথিবীব্যপী অঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল৷ কিছুদিন পর নাসা থেকে আমার কাছে মেইল আসে৷ পৃথিবীর ১২টির মধ্যে শৌর্যর ছবিও নাসা পাবলিশ করে৷ নাসার একাধিক প্রোজেক্টে শৌর্য কাজ করেছে৷ নাসার কুইজ প্রতিযোগিতাতেও সে ভালো ফল করে৷ নাসার তরফে তাকে শংসাপত্রও দেওয়া হয়৷ এখন নাসা, ইসরো সহ পৃথিবীর বড় বড় মহাকাশ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে ছেলে ওয়েবিনারে অংশ নিচ্ছে৷ তবে এখন তো ও খুবই ছোট৷ এই বয়সে কল্পনাপ্রবণ হয়ে ও এসব কাজ করে যাচ্ছে৷ বাবা হিসাবে চাই, ও যেটা ভালোবাসে, সেটা নিয়েই সারাটা জীবন যেন কাটাতে পারে৷ ওর নেশা যেন ভবিষ্যতে পেশা হয়ে যেতে পারে৷”