মলয় দে নদীয়া :-ভারতবর্ষের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ভাষা হলো সংস্কৃত। প্রায় পাঁচ হাজার বছর যাবৎ এই ভাষার চর্চা অব্যাহত রয়েছে। ঋগ্বেদে এ ভাষার প্রাচীন রূপটি পরিদৃষ্ট হয়। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দ ঋগ্বেদের রচনাকাল বলে ধরা হয়। ঋগ্বেদ থেকে উপনিষদের কাল পর্যন্ত এ ভাষা বৈদিক ভাষা নামে পরিচিত। প্রাচীনকালে সাধারণ্যে যে ভাষা প্রচলিত ছিল তাকে কেবল ‘ভাষা’ বলা হতো। পরে সংস্কারের মাধ্যমে গৃহীত হওয়ায় এর নাম হয় ‘সংস্কৃত’ (সম্-কৃ+ক্ত)।
কাল ও বিষয়গত দিক থেকে সংস্কৃত ভাষার দুটি স্তর: বৈদিক ও লৌকিক। এই লৌকিক ভাষাই ধ্রুপদী সংস্কৃত ভাষা নামে পরিচিত। এদুটি ভাষার প্রধান পার্থক্য স্বরবৈচিত্র্যে। তবে বর্তমানে বিভিন্ন কথ্য ভাষা বেশিরভাগই সৃষ্টি হয়েছে সংস্কৃত থেকে।
ভারতীয় সংস্কৃতি বুঝতে গেলে দরকার সংস্কৃতর।
কাব্য-নাটকসহ সাহিত্যের সকল শাখা সংস্কৃত ভাষায় অনুশীলিত হয়েছে। ধর্ম, ভাষাবিজ্ঞান, তুলনামূলক ব্যাকরণ, দর্শনশাস্ত্র, অলঙ্কারশাস্ত্র, তর্কবিদ্যা, শারীরবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, ফলিতজ্যোতিষ, রসায়ন, বীজগণিত, জ্যামিতি, চিকিৎসাবিজ্ঞান, পশুবিজ্ঞান, পূর্তবিদ্যা, যৌনবিজ্ঞান প্রভৃতি জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়েও সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়েছে অজস্র গ্রন্থ। এসব বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান লাভের জন্য সংস্কৃত ভাষার চর্চা একান্ত আবশ্যক।
ঔপনিবেশিক চক্রান্ত, কিছু পন্ডিতের সংস্কৃত চর্চার নামে জটিল করে তোলার ফলস্বরূপ বর্তমানে মৃত প্রায় হয়েছে ভারতের মাতৃভাষা।
তবে সংস্কৃতকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য সংবিধান সভায় পন্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্রের প্রস্তাব – সেপ্টেম্বর ১৩, ১৯৪৯ এ বহু প্রকার ন্যায় যুক্তিসঙ্গত বিষয় উল্লেখ থাকলেও, কিন্তু তাঁর সেই প্রস্তাব হিন্দির কাছে মাত্র একটি ভোটে হেরে যায়। আরো রুগ্ন হয়ে পরে আমাদের, গৌরবান্বিত ইতিহাস, অতীতের কৃষ্টি সংস্কৃতি সবকিছু। ধীরে ধীরে বহিরাগত পশ্চিমী প্রভাব পড়তে থাকে। হিন্দি রাষ্ট্রভাষা হলেও প্রায় সব ভাষাবীদরাই মনে করেন, ইংরেজির পরেই সংস্কৃত একমাত্র ভাষা, যা অত্যন্ত সরল-সাবলের এবং অন্যান্য ভাষার সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করে।
অন্যদিকে বিজ্ঞানও এই ভাষার পৃষ্ঠপোষক। আর সেই কারণেই নাসা বহুল প্রচলিত ৫০ টি ভাষার মধ্য থেকে ফিপথ জেনারেশন কম্পিউটার শব্দ মাধ্যম হিসেবে সংস্কৃত ব্যবহার করেছে, সৌর মন্ডলে স্যাটেলাইট পাঠানোর সময় অন্য কোন গ্রহে সভ্য মানবজাতি থাকলে তাদের বুঝতে সুবিধার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন ধরনের ছবির সাথে সংস্কৃত ভাষায় লিখে পাঠানো হয়েছে।
কারন নাসা মনে করে বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে গাণিতিক প্রয়োগ সম্ভব একমাত্র সংস্কৃত ভাষাতেই।
তবে, বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৩৫ টি দেশে সংস্কৃতি ভাষা নিয়ে গবেষণা চলছে, যার মধ্যে জার্মানি অন্যতম। সে সময় ম্যাক্স মুলার সাহেব এদেশের হৃদপিণ্ড স্বরূপ বিভিন্ন সংস্কৃত গ্রন্থ নিয়ে গিয়ে সে দেশকে সমৃদ্ধ করেছিলেন, আর যার ফলে আজ ভারতীয় ভাষা হওয়া সত্ত্বেও গবেষণার জন্য তাদেরই মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। যার মধ্যে অন্যতম কবি কৃত্তিবাসের পান্ডুলিপি যা এত বছরেও আজও ফেরানো সম্ভব হয়নি। তবে ভারতে কেরল হরিয়ানা তামিলনাড়ুতে আবারো সংস্কৃত চর্চার পীঠস্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে, দুঃখের বিষয় এ বাংলায় গুপ্তিপাড়া শান্তিপুর নবদ্বীপ এবং ভাটপাড়ায় সে সময় বহু টোল ছিলো আর তার ফলে আজও বহু প্রমান্য গ্রন্থ পান্ডুলিপি আবদ্ধ হয়েছে আলমারিতে। কোথাও রক্ষণাবেক্ষণ এর অভাব কোথাও বা ব্যবহারিক প্রয়োগ।
এত প্রমান্য গ্রন্থ থাকা সত্ত্বেও সংস্কৃত চর্চার প্রয়োগ খুব বেশি লক্ষ্য করা যায় না। সংস্কৃত ভারতীর উদ্যোগে আশির দশকে এ বাংলায় , পুনরায় সংস্কৃত শিক্ষণ শুরু হলেও ২০০৮ সাল থেকে ধারাবাহিকতার সাথে আজও সংস্কৃত র প্রচার এবং প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করছেন তারা।
নদীয়ার শান্তিপুর শহরে ২০১৩ সালে শান্তিপুর সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে মঠ বাড়িতে , এ প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের মাঝে স্বল্প সময়ের মধ্যে সংস্কৃত সম্ভাষণ শিক্ষণ শিবির আয়োজিত হয়েছিলো। দু’বছর করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে আবারো পথভ্রষ্ট হওয়া সংস্কৃত কে ছাত্র-ছাত্রীদের আর্থিক করে তোলার প্রয়াস শুরু করেছে সংস্কৃত ভারতী। গত ১১ ই অক্টোবর থেকে বিশে অক্টোবর পর্যন্ত দশ দিন যাবতকাল সময়ে বীনা প্রবেশ মূল্যে বয়স জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে শিক্ষণ শিবির চলছে শান্তিপুর পুরান পরিষদে। সংগঠন সূত্রে জানা গেছে এরপর আবারো শান্তিপুর সাহিত্য পরিষদে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে আগামীতে। সংগঠনের প্রশিক্ষক বিকাশ মণ্ডল জানান শুদ্ধ বাংলা বলতে এবং লিখতে গেলেও দরকার সংস্কৃত শেখার। কারণ বাংলা ভাষার শুদ্ধিকরণ করে সংস্কৃত।
ভাষা শ্রবণ পাঠ এবং লেখা বিভিন্ন স্তরের মধ্যে, প্রথমটি অর্থাৎ ভাষা মাত্র ১০ দিনেই শেখা সম্ভব সাধারণ ধারণা হিসেবে। কারণ মায়ের পেট থেকে শিশু জন্ম নেওয়ার পর কোন ব্যাকরণই জানেনা মায়ের দেখানোর নির্দেশ মেনে বলতে এবং বুঝতে পারে শিশু ঠিক তেমনি প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের করছি আমরা এরপর, আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার পর এমনিতেই সংস্কৃত চর্চা করব তারা। ভারতবর্ষের গৌরবান্বিত অতীত জানতে পারবে। তারাই রক্ষক হয়ে উঠবে এ ভাষার।
শান্তিপুর সাহিত্য পরিষদের সম্পাদক সুশান্ত মঠ বলেন, তাদের লাইব্রেরির পাঠক পাটিকা এই শিবিরে অংশগ্রহণ করেছে, আগামীতে তারাই পরিচালনা করবে এ ধরনের শিবিরে ছাত্র-ছাত্রীদের আগ্রহ দেখে, তিনি আত্মবিশ্বাসী পূর্বের পরিস্থিতি পুরোটা ফেরানো সম্ভব না হলেও, সংস্কৃত সম্পর্কে ভয় কেটে আত্মিক হবে অনেকটাই।