মলয় দে নদীয়া:- নদীয়ার শান্তিপুরে পালিত হলো বিরসা মুন্ডার প্রয়াণ দিবস। আদিবাসী বিদ্রোহ ইংরেজদের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছিল, ইংরেজদের কাছে হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রকৃত চিন্তার বিষয় তাদের মধ্যে অন্যতম মুন্ডা বিদ্রোহ। মুন্ডা বিদ্রোহের নেতা ছিলেন বিরসা মুন্ডা (Birsa Munda) যাঁর হাত ধরে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে আদিবাসী জাগরণ সূচিত হয়েছিল। বিরসা মুন্ডা তাঁর অনুগামীদের কাছে ছিলেন ‘ধরতি আবা’ অর্থাৎ ভগবান।
১৮৭৫ সালের ১৫ নভেম্বর বিহারে (বর্তমান ঝাড়খন্ডের) রাঁচির উলিহাতু গ্রামে বিরসা মুন্ডার জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম সুগানা মুন্ডা এবং মায়ের নাম করমি বাহাতু। ছোটবেলা থেকেই দেশ এবং জনরক্ষার প্রতি তার ছিলো আগ্রহ। নতুন কিছু শেখার এবং বাইরের জগতকে চেনার এক অদম্য ইচ্ছা ছিল তাঁর মধ্যে। কুন্তি ব্লকের সামলং স্কুলে তৃতীয় শ্রেণী অবধি পড়ার পর বিরসা মুরজু ব্লকের বুরুজু উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী পাস করেন। এরপর বিরসা চাঁইবাসায় লুথেরান জার্মান মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন এবং এখানে সপ্তম শ্রেণী অবধি পড়েন। চাঁইবাসার স্কুলে পড়ার সময় বিরসা খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করলে তাঁর নাম হয় ‘ডেভিড দাউদ’। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই বালক বিরসা আদিবাসী সমাজকে ব্রিটিশদের কবল থেকে মুক্তির জন্য চিন্তা করতেন।
১৮৮৬ সাল থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত বিরসা এবং তাঁর পরিবার চাঁইবাসাতেই বসবাস করত। একসময় জার্মান এবং রোমান ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের মধ্যে বিক্ষোভ শুরু হলে সেই আন্দোলনের রেশ গিয়ে পড়ল আদিবাসীদের মধ্যেও। স্বাধীনতা সংগ্রামের আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে সুগানা মুন্ডা বিরসাকে স্কুল থেকে সরিয়ে নিলেন। ১৮৯০ সালে চাঁইবাসা থেকে বিরসাকে নিয়ে সরদারদের প্রবল চাপে খৃষ্ট ধর্ম ত্যাগ করে গ্রামে ফিরে আসেন তাঁর মা। এরপর ১৮৯১ সালে বান্দাগাঁও গ্রামে বিরসার সাথে পরিচয় হয় বান্দাগাঁওয়ের জমিদার জগমোহন সিংয়ের মুন্সী আনন্দ পাওরের, যার প্রভাবে বিরসা বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন। ক্রমেই নিজ জাতিকে জাগ্রত করার দায়িত্ব বিরসা দক্ষতার সঙ্গে পালন করতে শুরু করেন। বিরসা আদিবাসীদের তাঁদের মূল ঐতিহ্যবাহী উপজাতীয় ধর্ম ‘সার্না পন্থা’ অনুসরণ করার পরামর্শ দেওয়া শুরু করলেন। লোকের মুখে মুখে বিরসা হয়ে উঠলেন ‘ধরতি আবা’ অর্থাৎ ভগবান, জগৎ পিতা।
মাত্র কুড়ি বছর বয়সে ১৮৯৫ সালে তিনি ঘোষণা করলেন এক নতুন ধর্মের যার মূল ভিত্তি ছিল একেশ্বরবাদী মুন্ডা ধর্ম। দলে দলে মুন্ডা, ওঁরাও, খরাই নরনারীরা নতুন ধর্ম গ্রহণ করে পরিচিত হল ‘বিরসাইত’ নামে।
বিরসা মুন্ডা ‘মুন্ডা বিদ্রোহে’র নেতা হিসেবে খ্যাত হয়ে আছেন। যদিও প্রথমেই তিনি হাতে অস্ত্র তুলে নেননি। কৈশোরে তাঁর হাতে থাকত একতারা আর কোমরে গোঁজা থাকত বাঁশি, প্রকৃতিও সাড়া দিত তাঁর বাঁশির শব্দে। কিন্তু অধিকারের লড়াইয়ে সেই হাতেই একসময় উঠে এল তীর ধনুক। মিশনারি স্কুলে থাকাকালীন বিরসা সরদারি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলেন আদিবাসীদের দুরাবস্থার জন্য একা দিকু (দিকু কথার অর্থ – ‘শত্রু’/আদিবাসীরা বহিরাগতদের দিকু বলত) অর্থাৎ ব্রিটিশরা দায়ী নয়, দেশীয় দিকুরাও ব্রিটিশদের সঙ্গ দিচ্ছে; আর তাই হয়ত নিজ বাসভূমে পরবাসী হয়ে আছে আদিবাসীরা।
ব্রিটিশরা ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চেয়েছিল। তারা একে একে দখল করতে থাকে অরণ্য জমি। আদিবাসীদের দখলে থাকা জমিগুলি তাঁদের থেকে অন্যায় ভাবে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ১৮৯৪ সালে ব্রিটিশ সরকার অরণ্য আইন প্রবর্তন করে ভারতের বিস্তীর্ণ জঙ্গল মহলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিল আদিবাসীদের। হাজার হাজার বছর ধরে যে জঙ্গলের ওপর ভরসা করে জীবনযাপন করতেন আদিবাসীরা, সেই অরণ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া হল তাঁদের থেকে। যখন ছোটোনাগপুরের সংরক্ষিত বন দখল করার উদ্যোগ নিল ব্রিটিশ সরকার, সেই সময় জেগে উঠল সমগ্র পাহাড় জঙ্গল ও বিরসাইত বাহিনী। ব্রিটিশের বন্দুকের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে তীর-ধনুক নিয়ে লড়াই শুরু হলো।বিদ্রোহের পরে বিরসাসহ তার শতাধিক সঙ্গী গ্রেপ্তার হন। বিচারে তার ফাঁসির হুকুম হয়।
ফাঁসির আগের দিন রাঁচি জেলের অভ্যন্তরে খাদ্যে বিষ প্রয়োগের ফলে বিরসার মৃত্যু ঘটে। ধৃত অন্যান্য দুজনের ফাঁসি, ১২ জনের দ্বীপান্তর এবং ৭৩ জনের দীর্ঘ কারাবাস হয়। সেই থেকে বিরসা মুন্ডা আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে যেমন ভগবান হলেন তেমনি সারা ভারতবাসীর কাছে হলেন বীর শহীদ।
নদীয়া জেলার শান্তিপুরে দিশারী নামক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আদিবাসীদের নিয়ে বিভিন্ন রকম কাজ করে চলেছে। সংগঠনের দিবা আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলতানের বাচ্চারা সামিল হয়ে এই আদিবাসী মহান নেতার প্রয়াণ দিবস পালন করে।
এই প্রসঙ্গত দিশারীর পক্ষে উৎপল মাহাতো জানান, বিরসা মুন্ডা আদিবাসীদের অন্যতম একজন নেতা। দিশারীর পক্ষ থেকে এই মহান নেতার প্রয়াণ দিবস পালন করা হলো। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে আদিবাসীদের অবদান ভোলার নয়। এই স্মরণসভায় আদিবাসী নেতাদের সম্পর্কে ছোট ছোট বাচ্চাদের ধারণা দেওয়া হলো যার মাধ্যমে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আদিবাসীদের কৃষ্টি সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারবে।