“Although her brushes were dry, but her eyes were not”
চাকরি জীবনের এক বছর অতিক্রম হয়েছে কয়েকদিন আগেই। আমি যা যা আশা করিনি জীবনের এই পর্বে তার অনেককিছুই ঘটছে বেশ কিছুদিন ধরে। হাওড়ার স্টেশন চত্তর ছেড়ে অনতিকাল পূর্বে ঠিকানা হয়েছে ডাকবিভাগের হেডকোয়ার্টারে। চারপাশের চেনা ট্রেণের হর্ন, টাইমটেবিল সব বদলে গিয়ে কানে আসে শুধুই অর্ডারের ফিসফাস। সুউচ্চ পনেরতলা এক বিশালাকৃতির অফিসের উপর থেকে প্রথম প্রথম নীচে বিন্দুর মত মানুষ দেখতে বড় ভালো লাগত৷ অনেকে বলত জীবনে বাজপাখির মত হতে, কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হল, যারা বলেছে তারাও কেউ বাজপাখি হয়ে দেখেনি কোনোদিন। দিন যত এগিয়েছে তত বুঝেছি বাজপাখির রাজকীয়তা আছে বটে, কিন্তু তার সাথে অনেক বেশী করে রয়েছে একাকিত্ব। দূরের বিন্দুর মত মাথাদের আমি অফিস বিল্ডিংএর অনেকখানি উপর থেকে দেখতে পেয়েছি হয়ত, কিন্তু তারাও আমাকে ততখানি বিন্দুর মতই প্রত্যক্ষ করেছে। তফাত শুধু একটাই। তাদের পাশে কথা বলার মত লোক ছিল, চারপাশে তাকিয়ে আমি দেখেছিলাম, আকাশের বাজপাখির মত আমিও বড় একা, বড় নি:সঙ্গ।
এসব করতে করতে একদিন খবর এল এক চিত্র প্রদর্শনীর কথা। অফিসে কান পাতলে শোনা যায় এক বিশাল পদাধিকারপ্রাপ্ত মানুষের শিল্পী সত্ত্বার ফিসফাস৷ যার চিত্র প্রদর্শনী তার নাগাল পাওয়া তো দূর অস্ত, তার পদাধিকারের মর্যাদা বোঝার মত বোধও তৈরি হয়নি আমার৷ যতখানি পদাধিকার থাকলে গর্ববোধ করা যায় বলে আমার মনে হত, তার থেকেও উচ্চপর্যায়ের আধিকারিকেরা ভীষণ ব্যাস্ত হয়ে পড়লে তবে আমি বুঝতে পারলাম সেই পদমর্যাদার গুরুত্ব। শুধু এটুকু বুঝতে পারলাম না, স্রষ্টার সৃষ্টি প্রত্যক্ষ করার উন্মাদনা, নাকি পদমর্যাদার অসীম গাম্ভীর্য, উৎসাহের উৎসস্থল কোনটা।
এসব নিয়ে যখন টানাপোড়েন চলছে, হঠাৎ একদিন ডাক পড়ল সেই ঘরে, যে ঘরে ঢোকার মত যোগ্যতা বা পদ কোনোটাই আমার হয়নি। অবাক চোখে এক শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে প্রবেশ করলাম আমি। চোখে মুখে অসীম বিস্ময় আর প্রবল ভয়। কিন্তু সে ভয় কেটে গেল ক্ষণিকেই। এক বছর পঞ্চাশের ভদ্রমহিলা, যার চোখে মুখে শান্তভাব আর মাতৃস্নেহ আর তার সমবয়সী আর এক ততোধিক স্নিগ্ধ ভদ্রলোক, পদমর্যাদা আর গাম্ভীর্যের পর্দা সরিয়ে আমন্ত্রণ করলেন আমাকে তাঁদের অবসর সময়ের প্রদর্শনীতে৷ আমি জানতাম না ঠিক কিভাবে এর প্রতিক্রিয়া দেওয়া যায়। পদমর্যাদার প্রতিফলনে আমার প্রতিটি শিরা উপশিরা অবশ হয়ে যাওয়াই সমীচীন, অথচ আপ্যায়নের উষ্ণতা অবশ হয়ে আসা আমার হৃদয়ে প্রাণ সঞ্চার করে চলেছে প্রতিমুহূর্তে। এ আমন্ত্রণে সাড়া না দেওয়ার মত শক্তি কোনো সাধারণ চেতনা সম্পন্ন মানুষের হবে বলে মনে হয় না।
প্রতিক্ষিত দিন এল, যে সমস্ত মানুষদের চেম্বারে লোকেদের হাঁটুতে হাঁটুতে ঠোকাঠুকি হতে দেখি তাদের দেখলাম অন্য বেশে। অফিসের লাল ফিতের সাথে শক্ত হয়ে বসে থাকা শার্ট আর প্যান্ট ছেড়ে তারা বেরিয়েছেন সাধারণ মানুষ হিসাবে। আমার রোজের বনগাঁ লোকাল, আমার আঁকার স্যার, মেট্রোর গেটে কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ মানুষ, বাসের জ্যামে আটকে ঢুলতে থাকা ভদ্রলোকের ছবি যে এই দুঁদে অফিসারদের মধ্যেও থাকতে পারে তা বোধহয় আমার প্রত্যক্ষ করা বাকি ছিল। সময় পেরোল, ছবির সমারোহ শুরু হল। বিভাগের সবথেকে উঁচুতে থাকা সবথেকে উঁচু আধিকারিক যে তার অবসরে ফুল আঁকতে পারে, পাহাড় আঁকতে পারে তা বোধহয় জানা ছিল না কারো। কিন্তু সব দেখেও একরাশ বিষন্নতা গ্রাস করতে থাকল আমায় প্রতিমুহূর্তে। দেওয়াল জুড়ে ক্যানভাসের মেলা লাল নীল হলুদ রঙের মেলা, কিন্তু সে রঙে প্রাণ নেই, সে রঙ শুধুই বর্ষা দিনে সাঁঝবাতির মত ফ্যাকাশে। ঘরের ছোট্ট মোমবাতি যেমন অন্ধকার ঘরকে আরো অন্ধকার করে তোলে, সেই ক্যানভাসও যেন তাই। তাতে আনন্দ নেই, উচ্ছাস নেই। আছে শুধু আকুলতা। এর পর সেই স্মিতবাক স্নিগ্ধ বছর পঞ্চাশের ভদ্রলোক দাঁড়ালেন সেই চারদেওয়ালের মাঝে৷ তার পাশে যিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তাঁকে দেখে ভয় পাওয়া উচিত হলেও, মন থেকে ভেসে আসছে না ভয়ের শিহরণ। উচ্চারিত হল অমোঘ স্বীকারোক্তি। এক বৃদ্ধ স্বামী স্ত্রীকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে উৎসুক স্রোতার দল। আর সেই বৃদ্ধ বৃদ্ধা ভাগ করে নিচ্ছেন তাদের জীবনের কঠিনতম লড়াইকে। ক্ষমতা, অর্থ, জৌলুসের কোনো কমতি ছিলনা তাদের, কিন্তু জীবনের সব রঙ, সব জৌলুসকে ফিকে করে দিয়ে বিদায় নিয়েছে প্রাণের ছোটটি, শাশ্বত।
বছর পঁচিশের সমী যখন চলে যায়, চোখের জল ঝর্না কলম বেয়ে নেমে এসে এঁকেছিল এক ছবি, এক সন্তানহারা পিতার আর্তনাদ৷ আর এই এক পিতামাতা, জীবনের বাকি সবটুকু রঙ নিঙড়ে দিয়ে এঁকেছেন তার ছেলের দৃষ্টি, কিশোরের ঔৎসুক্য। এতক্ষণ ফিকে হয়ে থাকা ক্যানভাস এক লহমায় তুলল সুর, ছেলেবেলার প্রথম পেন্সিল ধরা হাতের ফুল থেকে তুলিতে আঁকা “শাশ্বত” কল্পচেতনা। এ শুধু প্রদর্শনী নয়, কোনোদিন ছিল না, সকলের অলক্ষ্যে এ ছিল সন্তানহারা এক মায়ের তার সন্তানকে খোঁজার আকুলতা৷ আমি পদমর্যাদার ভার বুঝিনা, আমি চোখের জলের ভাষা বুঝি। চিরকাল কাঁধে অসীম ভার রেখে আসা এক কঠিন নারীর চোখের বাঁধ ভাঙতে গেলে যে কতটা জল জমতে হয় সে বোধহয় আমার জানা ছিল না। আজ জানলাম। দূরে দুর্গাপুজোর ঢাক বাজা শুরু হয়েছে। কলকাতার অলিতে গলিতে ধূপের গন্ধ, আনন্দ উন্মাদনা। আমরা ফিরেছি আবার৷ সেই পনেরতলা বিল্ডিং এর নীচে। কে বলতে পারে বাজপাখির উচ্চতায় বসে এক মায়ের চিৎকার যে হারিয়ে গেলনা এই ঢাক আর কাসরের কলরবে। হয়ত রোজই যায়। শুধু আমরা শুনতে পাইনা। আকাশের বাজপাখি আসলেই যে বড় একা, বড় নি:সঙ্গ।
Exhibition : Kalanjali An ode to eternity
Artist : Dr. Sikha Mathur Kumar
Venue : ICCR
Date : 9-11th October 2021 (3PM-8PM)