মলয় দে নদীয়া:- প্রায় সাড়ে পাঁচশও বছরের বেশি প্রাচীন শান্তিপুরের দত্ত পাড়ার জমিদার বাড়ি ওরফে রায় বাড়ি অর্থাৎ নদিয়া জেলার ঐতিহ্য মন্ডিত জমিদার বাড়ির দুর্গা পুজো। এই বাড়ির দুর্গা পুজোর সাল সঠিক ভাবে জানা না গেলেও পরিবার সূত্রে জানা গেল প্রায় পাঁচশো বছরের বেশি প্রাচীন নদিয়ার শান্তিপুর শহর অন্তর্গত দত্ত পাড়া রায় বাড়ির দুর্গা পুজো । রথ যাত্রা অনুষ্ঠানের সময় এই বাড়ির মাতৃ মূর্তির পাটে সিঁদুর চন্দন লেপন করার রীতি রয়েছে , এবছরেও সেটার ব্যতিক্রম হয়নি ।
দুর্গা মূর্তি দেবীর দালানেই তৈরি করা হয় । মাতৃ মূর্তি তিন পুতুলের হলেও সাতটি খাটাল বিশিষ্ট মন্দির শান্তিপুরে এই প্রথম দত্ত পাড়ার রাজবাড়ী ছাড়া আর কোথাও প্রতিয়মান হয় না ।রায় বাড়িটিতে ঢুকতেই সুবিশাল দরজা , একদম সোজাসুজি সাত খাটালের ঠাকুর দালান । সুউচ্চ জানালা ও দরজার খিলান , করি ও বড়গার ঘর , ঠাকুর দালানের ভিতর সুউচ্চ জানালা , ভিতরে লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা কাঠের সিঁড়ি প্রাচীন ঐতিহ্য বহন করে চলেছে ।
সংবাদ মাধ্যমের সাথে কথোপকথন সুত্রে জানা গেল, এই রায় পরিবারের দুর্গাপুজোয় সপ্তমী , অষ্টমী এবং নবমী — এই তিনদিন মাতৃ মূর্তির উদ্দেশ্যে ভোগ নিবেদনের রীতি রয়েছে । যদিও এই বাড়িতে একটি রাধা কৃষ্ণের মূর্তি রয়েছে সেটা গৌর হরি নামেই পরিচিত । দুর্গা পুজোর সময় এই রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তির উদ্দেশ্যে ভোগ নিবেদন করা হয় ,কিন্তু কাকতালীয় ভাবে দুটি ভোগের স্বাদ সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে যায় বলেই জানাচ্ছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো অন্তত চল্লিশ থেকে পয়তাল্লিশ ইঞ্চি র দুর্গা পুজোর পুষ্প পাত্র শান্তিপুর দত্ত পাড়ার রাজবাড়ীতে দেখতে পাওয়া গেলো । এত বৃহৎ দূর্গা পূজার পুষ্প পাত্র সচররাচর শান্তিপুরে আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না ।শান্তিপুরের এই দত্ত পাড়া রায় বাড়ির থেকে শান্তিপুর মিউনিসিপ্যাল স্কুলে আসার এবং শান্তিপুরের গঙ্গায় যাবার গোপন একটি সুরঙ্গ পথ ছিল বলে শান্তিপুরের প্রাচীন ইতিহাস সূত্রে জানা যায় । কিন্তু কালের নিয়মে সম্পূর্ণ বিষয়টি বন্ধ হয়ে গেছে । একসময় শান্তিপুর পাবলিক লাইব্রেরিতে এই বাড়ির দুর্গা পুজো হতো , কিন্তু এই পরিবারের হরিদাস রায়ের অমল থেকে তার বিলুপ্তি করন ঘটে । হরিদাস রায় ছিলেন এই বংশের শেষ জমিদার । শান্তিপুর দত্ত পাড়া রায় পরিবারের সকল জমিদারদের মধ্যে উমেশ চন্দ্র রায় ওরফে মতি রায় ছিলেন অন্যতম । তিনি প্রথম জীবনে বর্ধমান রাজ সরকারের দেওয়ান থাকলেও পরবর্তী কালে তিনিই ছিলেন শান্তিপুরের জমিদার । অনেকের মতে তিনি স্বৈরাচারী হলেও যথেষ্ট প্রজা হিতৈষী ও শিল্প সংস্কৃতির গুণগ্রাহী ছিলেন । তার অন্যতম সামাজিক কার্যাবলী ছিল নীল বিদ্রোহে নেতৃত্ব দান করা এবং শান্তিপুরের প্রথম ইংরেজি বিদ্যালয় হিসাবে মিউনিসিপ্যাল উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপন করা এবং তার বাড়ির অপর আরেকটি অংশ শান্তিপুর পৌরসভাকে হস্তান্তর করন যেটা শান্তিপুর পাবলিক লাইব্রেরি হিসাবে পরিচিত । একসময় মতিবাবু এই বাড়ির দুর্গা পুজোয় প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন এবং প্রতিমাকে স্বর্ণ ও রৌপ্য অলঙ্কারে সাজাতেন এবং বিজয়ার পর সেগুলো ব্রামহণ দের বিতরণ করতেন । অন্যদিকে মতি রায়ের অনেক হটকারী সিদ্ধান্তের কথাও জানা যায় । মতি রায় তার লাঠিয়ালদের দ্বারা কোনো একটি কারণ বশত তার বেশ কয়েক জন প্রজাদের হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন । এই সময় বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী সমস্ত বিষয়টি প্রত্যক্ষ করে তাদের উক্ত কার্য থেকে বিরত করেছিলেন । শান্তিপুরের ইতিহাস থেকে জানা যায় পুজোর শোভা যাত্রা চলাকালীন শান্তিপুর জর্জ বাড়ির সাথে প্রায় ই হাঙ্গামা বাধাতেন । উক্ত ঘটনায় এক ব্যাক্তির মৃত্যু হলে দুই পরিবারের শোভাযাত্রার পথ ভিন্ন হয়ে যায় ।বর্তমানে এই বাড়ির প্রতিমা নির্মাণ মৃৎ শিল্পী প্রদীপ পাল । তবে দত্ত পাড়া রায় বাড়ি সুত্রে খবর প্রায় আট পুরুষ ধরে এই বাড়ির প্রতিমা নির্মাণ করছেন প্রদীপ পালের বংশধরেরা।