ড. মিলন রায়, সহ: অধ্যাপক, আনন্দ মোহন কলেজ, কলকাতা ।
বঞ্চিত জাতির স্বতন্ত্র সত্তা নির্মাণের জন্য বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় যাদের নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে আম্বেদকর তাদের অন্যতম। অস্পৃশ্য ও উচ্চবর্ণের মধ্যে শোষণ বিরোধী আভিযানে অন্তর্দৃষ্টি ব্যবহার করে অস্পৃশ্যদের মধ্যে এক চেতনা বোধ গড়ে তুলেছিলেন। তিনি অস্পৃশ্যদের মধ্যে চেতনার জাগরণ ঘটিয়ে তাদের সার্বিক উন্নতি সাধন করতে চেয়েছিলেন। হাজার হাজার বছর ধরে দারিদ্র ও বৈষম্যের জগদ্দলের নীচে পিষ্ট, ক্লিষ্ট মানুষ সাম্যের আধিকারকে কেন্দ্র করে একটি রাজনৈতিক পরিসর তৈরি করে যার ছত্রছায়ায় নিজেদের মানুষ হিসাবে নুন্যতম সম্মান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রসর হয়। কিন্তু যুগ যুগ ধরে অস্পৃশ্য মানুষদের সম্পর্কে উচ্চবর্ণের উন্নাসিক মানুষদের যে মনোভাব তৈরি হয়েছে তা রাতারাতি আইনের মাধ্যমে নির্মূল করে দেওয়া সম্ভব নয়। কারন তার পরিবর্তনের বিপরীতে একাধিক বিরাট বাধা রয়েছে। প্রান্তিক নিচুজাতির মানুষগন যে তিমিরে অবস্থান করছিলেন তাতে তাদের এই অবস্থা থেকে মুক্তির কোন উপায় ছিল না। গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ শোষিত, লাঞ্ছিত, দলিত শ্রেণির মানুষ দারিদ্রের কারনে যেমন গ্রামের পরিচিত গণ্ডি পেরিয়ে শহরে পাড়ি দেয়। তবে অনেকক্ষেত্রে এর পিছনে অপমান, অস্পৃশ্যতা, বঞ্চনা প্রকৃত কারন রুপে বিদ্যমান থাকে। ইচ্ছাকৃতভাবেই তাদেরকে শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে রাখা হয়েছে, তাদের সম্পত্তির আধিকার দান করা হয়নি এমনকি দাসসুলভ ব্যবহার করা হয়েছে। তবে সময়ের সাথে সাথে নানা পরিবর্তনও এসেছে। এই অবহেলিত দলিতদের মধ্যে এসেছে শিক্ষা, চেতনা, আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়তা যা তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার নানা পরিবর্তন এনেছে ও আনছে।
বাবাসাহেব আম্বেদকরের পিতা ছিলেন কবিরপন্থী। তিনি চেয়েছিলেন উদার হিন্দুধর্মের চেতনায় অস্পৃশ্যরা স্বীকৃত হোক, ফিরিয়ে দেওয়া হোক তাদের সহজাত মানবিক আধিকার। বৈষম্যকে স্বীকৃতি দানকারী হিন্দু ধর্মের চতুর্বর্গ ব্যবস্থাকে তিনি ধর্ম ও সমাজ বৈষম্যের মূল ও অস্পৃশ্যতার জননী বলে মনে করতেন। তিনি তৎকালীন বিদ্বৎসমাজ ও ধার্মিকদের বারংবার হিন্দুধর্মের ত্রুটিগুলি সংশোধনের জন্য অনুরোধ করলে তারা তাতে কর্ণপাত করেননি। এমনকি গান্ধীর মত মানুষের কাছ থেকেও এসেছিল প্রাথমিক বিরোধীতা, গান্ধীজী বলেছিলেন অস্পৃশ্য হিন্দুদের অন্তর্গত হিন্দুদের সঙ্গেই দলিতদের অস্তিত্ব নির্ধারিত হয়ে থাকবে। হিন্দুদের যে কোন ব্যবহারই দলিতদের মেনে নিতে হবে। আম্বেদকর তাঁর সুচিন্তিত যুক্তির দ্বারা গান্ধীর মতকে খণ্ডন করেছিলেন। হিন্দুধর্মের অস্তিত্ব বৈষম্যনির্ভর, শাস্ত্রমতের মধ্যেও বিদ্যমান রয়েছে বিষমতার ভাবনা। এই ধর্মে গালভরা উদারতা ব্যক্ত করা হলেও আদতে মানবিকতার অধিকার বিশেষ বর্গের মধ্যেই সীমায়িত। আম্বেদকর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে আন্ত্যজ শ্রেনীর আশা আকাঙ্ক্ষা পরিপূরণের জন্য, স্বীকৃতিদানের জন্য আইনি ব্যবস্থার অধীনে একটি সাংবিধানিক ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতালোভী উচ্চশ্রেণীর এলিটদের পক্ষে তা কোনভাবেই মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।
বাবাসাহেব আম্বেদকর প্রান্তিক মানুষদের কথা ভেবেছিলেন অন্যরুপে অন্যভাবে। তিনি সামাজিক গণতন্ত্রে সকলের জন্য সমান সুযোগ ও ন্যায়বিচার দানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি বলতেন ধর্ম মানুষের জন্য, মানুষের জন্য ধর্ম নয়। যে ধর্ম মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করে না, তৃষ্ণার জলটুকুও নির্মমতার সঙ্গে সরিয়ে নেয়, সেই ধর্ম আর যাই হোক; কোন ধর্ম নয়।
জীবনের শেষ পর্যায়ে আম্বেদকর স্বীকার করেছিলেন যে তাঁর সারা জীবনের যে লক্ষ্য, তা তিনি সফল করতে পারেন নি। তাঁর জন্য তিনি যেমন বৃহত্তর সমাজকে দোষ দিয়েছেন, তেমনি তাঁর নিজের সমাজকেও দায়ী করেছেন। তাঁর কথায়– I feel sad because I have not been able to fulfill my mission to the extent I wanted….whatever I have been to achieve is being enjoyed by the educated few who have proved to be the worst ; with no sympathy for their poor, ignorant brethren. আম্বেদকর মনে করতেন, স্বাধীনতা ও সাম্য অর্জনে নৈতিকতা অপরিহার্য। নির্বাচনী রাজনীতি, আধুনিকীকরন বা উদারবাদী গণতন্ত্রে নয়, একমাত্র ব্যাক্তিমানসের পরিবর্তনের মাধ্যমেই সামাজিক রূপান্তরের সুফল পাওয়া সম্ভব বলে তাঁর বিশ্বাস ছিল। তিনি ধর্মকে মানুষের উন্নতির মাধ্যম, বিশুদ্ধতার প্রতীক রূপেই ভাবতেন। তাঁর মতে সমাজ যতটা উন্নত, বুদ্ধির অনুগামী হবে, ততই বৌদ্ধধর্ম তাদের আশ্রয় দেবে, আপনকরে নেবে। একথা অবহেলিত হলেও সত্য যে আম্বেদকরের চিন্তাভাবনা ও তাঁর দর্শনকে যত বেশী উপেক্ষা করা হয়েছে, ততই তিনি উন্নীত হয়েছেন দেবত্বের আসনে। সাম্প্রতিক তাঁর মতধারার উগ্র বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দলগুলিও তাঁর কৃতিত্বকে স্বীকার করছেন। কোটি কোটি শোষিত, অপাংত্তেয় দলিতদের কাছে আম্বেদকরের অস্তিত্ব দেবতার আসনেই থাকবে।
আজ মহামানবের প্রয়াণ দিবসে নিউজ সোশ্যাল বার্তা জানায় শ্রদ্ধার্ঘ্য ।