রাহুল দেব বর্মনের ৮৪ তম জন্মদিন পালন নদীয়ার শান্তিপুরে 

Social

মলয় দে নদীয়া :- এক কথায় তিনি ছিলেন সুরের যাদুকর ৷ তাঁর ছোঁয়ায় সৃষ্টি হয়েছে অজস্র সুমধুর সঙ্গীত ৷ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তিনিই শ্রেষ্ঠ তিনিই স্রষ্টা। তিনি স্বয়ং স্বরলিপির পঞ্চম সুর !
তাঁকে পঞ্চমদা বলে সম্বোধন করতেন অনেকে। এই পঞ্চমদা নামের পেছনে আছে একটি ছোটগল্প। ছোটবেলায় যখন কাঁদতেন তখন নাকি তার কান্নার আওয়াজ নাকের গোড়া থেকে অনেকটা ‘সারেগামাপাসা’র ‘পা’র মতো শোনা যেত। স্বরলিপির পঞ্চম সুরে কাঁদতেন বলে তাকে ডাকা হতো ‘পঞ্চম’ নামে। সংগীতপ্রেমী পরিবারে এ-ও ছিলো এক মজার রসিকতা। আর এ রসিকতার রেশ ধরেই তার নামও হয়ে যায় পঞ্চমদা। অবশ্য কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী শচীন দেবের সন্তানের কান্নার আওয়াজ তো ‘পা’র মতো শোনাবেই।

কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী রাহুল দেব বর্মণ কলকাতার ত্রিপুরার রাজপরিবারে জন্মেছিলেন ১৯৩৯ সালে ২৭ জুন। আজ তাঁর ৮০ তম জন্মদিন ৷

আর ডি বর্মণের বাবা কিংবদন্তি সুরস্রষ্টা শচীন দেব বর্মণ জন্মেছিলেন বাংলাদেশের ফরিদপুরে। তবে পঞ্চম কখনও পিতৃভিটায় আসেননি। বাবার পথ ধরেই সুরের ঝরণায় গা ভাসিয়েছেন ছেলে। সংগীত পরিবেশে বেড়ে ওঠা রাহুল একসময় হয়ে ওঠেন ভারতের জনপ্রিয় গায়ক এবং সুরকার। ওই যুগে শুধু আর ডি বর্মণের গান ও সুর ব্যবহারের জন্য অনেকেই ছবি বানাতেন ! তার করা গান আর সুরের নতুন নতুন সংস্করণ আজও বিভিন্ন চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হয়।

তিনিই প্রথম ভারতীয় সংগীত জগতে পরিচিত করেছিলেন ইলেকট্রিক গিটার, রক অ্যান্ড রোলের সংমিশ্রণ। এভাবেই তিনি জাদু দেখিয়েছিলেন ‘তিসরি মঞ্জিল’ ছবির ‘আজা আজা ম্যায় হু পেয়ার তেরা’ গানে। এ ছাড়াও আরডিই প্রথম বলিউডে ব্লুজ ও লাতিন আমেরিকান সংগীতের প্রবর্তন করেন।

হিন্দি গানের জন্য সুনাম কুড়ালেও সবার প্রিয় পঞ্চমদা আগাগোড়াই ছিলেন একজন বাঙালি।
৩৩ বছরের পেশাদার জীবনে তিনি ৩৩১টি ছবির সংগীত পরিচালনা করেন। এর মধ্যে ছিল ২৯২টি হিন্দি, ৩১টি বাংলা, ৩টি তেলেগু, ২টি করে তামিল ও ওড়িয়া এবং ১টি মারাঠি ছবি। ১৯৬১ সালে তিনি প্রথম কাজ করেন অভিনেতা মেহমুদ প্রযোজিত ‘ছোট নবাব’ ছবিতে। অন্যান্য ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য — ‘শোলে’, ‘গোলমাল’, ‘সনম তেরি কসম’, ‘মাসুম’, ‘ইয়াদো কি বারাত’, ‘খুবসুরত’, ‘১৯৪২ এ লাভ স্টোরি’, ‘ক্যারাভান’, ‘আপ কি কসম’, ‘খেল খেল মে’, ‘মেহবুবা’, ‘হাম কিসিসে কাম নাহি’, ‘কিনারা’, ‘শালিমার’, ‘শান’, ‘বেতাব’, ‘সাগর’ প্রভৃতি। এর মধ্যে ‘১৯৪২ এ লাভ স্টোরি’ ছবিটি মুক্তির আগেই তার প্রয়াণ হয়।

এরপর ‘বাচনা এ হাসিনো’, ‘মনিকা ও মাই ডার্লিং’, ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’, ‘মেরে ন্যায়না সাওন ভাদো’, ‘চিঙ্গারি কোই ভাড়কে’, ‘দম মারো দম’, ‘চুরালিয়া হ্যায় তুমনে জো দিল কো’, ‘পিয়া আব তু আজা’, ‘যাহা তেরি ইয়ে নজর হ্যায়’, ‘চালা জাতা হু কিসিকি ধুন মে’, ‘তু তু হ্যায় ওহি’, ‘মেহবুবা মেহবুবা’, ‘ইয়ে দোস্তি’, ‘আজা মেরি জান কাহা থা তুনে সনম’, ‘এক লাড়কি কো দেখা তো’ এমন অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা আরডি বর্মণ। এসব গান আজও রিমেক করা হয়। এ ছাড়া ছবির দৃশ্য অনুযায়ী আবহসংগীতেও জমিয়ে তাল মেলাতেন তিনি। সেরা সংগীত পরিচালক হিসেবে (ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডস) তিনবার পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। আর অসংখ্যবার মনোনীত হয়েছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবনে রাহুল দেব বর্মণ ১৯৬৬ সালে প্রথম বিয়ে করেন রিতা প্যাটেলকে। দার্জিলিংয়ে পরিচয় হয়েছিল তাদের। রিতা ছিলেন পঞ্চমের অন্ধভক্ত। পাঁচ বছরের মাথায় তাদের বিয়ে বিচ্ছেদ হয়। এরপর ‘পরিচয়’ (১৯৭২) ছবির ‘মুসাফির হু ইয়ারো’ গানটি হোটেলে বসে সুর করেছিলেন আরডি বর্মণ। ১৯৮০ সালে তিনি বিয়ে করেন প্রখ্যাত গায়িকা আশা ভোঁসলেকে। এই সংগীত দম্পতি একসঙ্গে অনেক কালজয়ী গান উপহার দিয়েছেন শ্রোতাদের।
জীবন সায়াহ্নে এসে অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল হয়ে পড়েছিলেন পঞ্চমদা। ১৯৯৪ সালের ৪ জানুয়ারি মারা যান তিনি। আরডি বর্মণকে মনে করা হতো হিন্দি ছবির সংগীতাঙ্গনের ভগবান। কিংবদন্তি এই শিল্পীর সুরের জাদু তার মৃত্যুর দুই দশক পরও সমানভাবে নাড়া দেয় শ্রোতাদের।
শুধু রাজ্য নয় সারা দেশ জুড়ে এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও প্রবাসী বাঙালি বা সেই সমস্ত এলাকার অধিবাসী আজও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে তার সৃষ্ট সুর কথা গান। আর সেই কারণেই সর্বত্র আজ সকলের মুখোমুখি গুঞ্জন আর ডি বর্মনের গান। শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানাতে সংগীত এবং বাদ্যযন্ত্রের জগতে আজ এক বিশেষ দিন হিসাবে পালন এবং উপভোগ করছেন তারা। নদীয়ার শান্তিপুরে আজ থেকে বার বছর আগে এইরকমই বেশ কিছু সংগীতপ্রেমী মানুষজন গড়ে তুলেছিলেন সংগঠন বাঁশরী। সারা বছর গান বাজনা অনুশীলন করার মধ্য দিয়ে বছরে বিজয়া সম্মেলনী, বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং তাদের পথপ্রদর্শক আর ডি বর্মনের জন্মদিন পালন করে থাকেন। আজ শান্তিপুর লাইব্রেরী গেটে তারা কেক কেটে সংগীতগুরুর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য জানান। এই উপলক্ষে সন্ধ্যায় থাকছে সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যেখানে শুধুমাত্র আর ডি বর্মনের গানেই মাতবে গোটা শান্তিপুর। যদিও শুধু সাংস্কৃতিক নয় তারা সামাজিক দায়িত্ব পূরণেও এগিয়ে আসে। বিগত বছর গুলিতে, বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের হুইলচেয়ার প্রদান হাসপাতালে স্ট্রেচার প্রদান করোনা পরিস্থিতির মধ্যে প্রান্তিক পরিবার গুলিকে সাহায্য প্রদান এভাবেই নানা সামাজিক কাজকর্মে এগিয়ে থাকেন তারা।

Leave a Reply