ডাকাতরা নেই,তবু ডাকাতের নামেই উৎসর্গ করা হয় নদীয়ার এই কালী পূজা

News

ডাকাতরা নেই,তবু ডাকাতের নামেই উৎসর্গ করা হয় পূজা

অঞ্জন শুকুল নদীয়া: ডাকাতি করে এসে ডাকাতরা করত মা কালীর পুজো । তাই এই কালীর নাম ডাকাতে কালী । এই পুজোর বয়স প্রায় একশ দশ বছর  ভীষণ জাগ্রত এই ডাকাতে কালী । পুজোতে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস।

নদীয়ার মাজদিয়ার ঘোষপাড়া ডাকাতে কালীতলায় ধুমধাম করে পুজো হচ্ছে এবারেও । প্রাচীন এই পুজোকে ঘিরে রয়েছে দারুণ কাহিনী । জানা যায় ,আজ থেকে প্রায় একশ দশ বছর আগে ওই গ্রামের দিন কাটছিল অভাব -অনটনের মধ্যে দিয়ে। অনেকই পাচ্ছিলেন না দুবেলা -দুমুঠো খাবার । সেই করুন অবস্থা ওই গ্রামের কয়েকজন তরতাজা যুবক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তারা ডাকাতি করবেন । ডাকাতি করেই যোগাড় করবেন গ্রামের মানুষের জন্য খাবার।l তখন চলছে কড়া ব্রিটিশ শাসন । হটাত্ -ই ওই যুবকেরা খবর পেলেন ,ঢাকার দিকে যাচ্ছে ব্রিটিশদের মালবাহী ট্রেন । ওই ট্রেনেই তারা ডাকাতি করার সিদ্ধান্ত নেন ।রাত হয়ে গিয়েছে মাজদিয়ার ইছামতি ব্রিজের ওপর দিয়ে ব্রিটিশদের মালবাহী ট্রেনটি যাচ্ছিল ,কু -ঝিক ঝিক করে । হাতে লন্ঠনের লাল আলো দেখিয়ে ব্রিজের ওপরই দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল ট্রেনটিকে । সময় নষ্ট না করে ট্রেনের বগি থেকে কাপড়ের বান্ডিল বেশ কয়েকটা ফেলে দেওয়া হল নদীর জলে লুট করা হল খাদ্যসামগ্রীও ।

ট্রেন বেড়িয়ে গেল ঠিকই । কিন্তূ অল্প সময়ের মধ্যেই খবর পৌঁছে গিয়েছিল ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে l শুরু হয়ে গেল খোঁজ -খোঁজ । ডাকাতদলের লোকজন আশ্রয় নিয়েছিলেন জঙ্গলে। ব্রিটিশ বাহিনী নদীতে ফেলা কাপড়ের বান্ডিলের হদিশ পাইনি l সেই কাপড় তুলে ও লুট করা খাদ্য সামগ্রী ওই ডাকাতেরা গ্রামের মানুষের মধ্যে বিলি করেন  কিন্তূ যারা করেছে এই কাজ ,তাদের সন্ধানে ব্রিটিশদের খোঁজ খবর চলছিল কড়াভাবেই । ওই এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে ,ওই ডাকাতদলে ছিলেন দুলাল প্রামাণিক ,হেমন্ত বিশ্বাস ,ভরত সর্দার ,কৃত্তিবাস মিত্র ,অবিনাশ ক্যারিয়া ,গিরীন্দ্রনাথ ঘোষ নামে কয়েকজন যুবক । ব্রিটিশবাহিনীর কাছে ধরা পড়ার ভয়ে জঙ্গলেই কাটতে লাগল তাদের সময় । সেইসময় তারা স্মরণ করেছিলেন মা কালীকে বলেছিলেন ,’মা তুমি বাঁচিয়ে দাও আমরা তোমার পুজো দেব । ‘অলৌকিকভাবেই সেবার তাদের সন্ধান পায়নি বৃটিশরা , ফিরে যেতে হয় তাদের । ব্রিটিশবাহিনীর ফিরে যাওয়ার পরদিনই ছিল অমাবস্যা ,কালীপুজো  জঙ্গল থেকে বেড়িয়ে একটি বেল ও নিম গাছের পাশেই বেদি বানিয়ে ডাকাতরা করেছিলেন মা কালীর পুজোর আয়োজন । জোর করে ভূদের মালাকার নামে একজন প্রতিমাশিল্পীকে ধরে এনে ঠাকুর বানানো হল । গ্রামের চক্রবর্তী পরিবারের লোককে দিয়ে বাধ্য করানো হল পুজো করতে । প্রতিমা বানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রং করিয়ে পাটে তোলা হল মায়ের প্রতিমা । সেইসময়ের ডাকাত হেমন্ত বিশ্বাসের পরিবারের সদস্য সুনীল বিশ্বাসের কাছ থেকে জানা সেদিনের অনেক কাহিনী -ই । যদিও সেদিন যারা ডাকাত বলে পরিচিত ছিলেন ,তাদের মাজদিয়ার ঘোষপাড়ার মানুষ সন্মানের চোখেই দেখেন বলে জানালেন প্রাক্তন শিক্ষক সুকুমার ঘোষ ।তাদের বক্তব্য ,’ওঁরা ডাকাতি করতেন ঠিকই ,তবে কোনদিন মানুষ খুন করেননি  শুধু তাই নয় ,ডাকাতি করা জিনিসপত্র তারা বিলিয়ে দিতেন গ্রামের মানুষের মধ্যেই , তারাই আবার ডাকাতির টাকা -পয়সা দিয়ে করতেন মায়ের পুজো । তাই এইখানে মা কালী ডাকাতে কালী বলেই পরিচিত । ‘যদিও সেদিনের সেই ডাকাতদের পরিবারের উত্তরসুরিরা কেউ শিক্ষক ,কেউ পুলিশে ,কেউ সেনাবহিনীতে কাজ করেন । সেদিন ডাকাত হেমন্ত বিশ্বাসের পরিবারের সদস্য সুনীল বিশ্বাস একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ছিলেন তিনারা কাছ থেকে জানা তথ্য অনুযায়ী জানাযায় বছরে কয়েকবার ডাকাতি ছিল ,তবে কালীপুজোর আগে ওঁদের ডাকাতি করা চাই -ই নইলে যে মায়ের পুজো হবে না । একবার ওঁদের ডাকাতি আটকাতে পুলিশ ওঁদের থানায় নিয়ে গিয়ে আটকে রাখল সন্দেহের বশে । থানার সামনে চাদর -কম্বল মুড়ি ওঁরা ষোল -সতের জন শুয়ে থাকল  পরদিনই কালীপুজো কী হবে ?অনেক রাত হয়ে গিয়েছে গ্রামের কয়েকজন পুলিশের নজর এড়িয়ে ওঁদের চাদর -কম্বলের তলায় আশ্রয় নিল । ওঁরা বেড়িয়ে গেলেন ডাকাতি করতে, ডাকাতি সেরে ডাকাতির মালপত্র এক জায়গায় রেখে ওঁরা নিজেদের জায়গায় ফিরে এসে কম্বলের তলায় শুয়ে পড়ে ।যারা আগে থেকে ছিল ,তারা বেড়িয়ে আসে পুলিশ বুঝতে পারেনি পরদিন ওঁরা ছাড়া পেয়ে মায়ের পুজো দিলেন  বাকি সামগ্রী গ্রামের মানুষদের বিলিয়ে দেন । আসলে ওঁরা সবসময়ই মাকে স্মরণ করতেন l ডাকাতি করতেন গরীব মানুষদের জন্য  ‘জানা যায় ,ওঁরা কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি ,ট্রেজারিতেও ডাকাতি করেছেন মুখে মুখে আজও ঘোরে একটা গল্প । একবার রাজবাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়ে পাহারাদারকে ওঁদের একজন অভিনয় করে বলেন ,বাবু আমার ছেলের শরীর খুবই খারাপ একটূ সাহায্য করুন । পাহারাদার ভেতর থেকে কিছু সাহায্য করতে এগিয়ে আসলে,ওদের একজন বলেন ,বাইরে এসে দিতে  বাইরে আসতেই তাকে বেঁধে ওঁরা ডাকাতি করেন । রণপা পড়ে ওঁরা যেতেন ডাকাতি করতে যাতে পায়ের চিন্হ না থাকে  ওঁরা অনেক ডাকাতি করে তা গ্রামের মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে ডাকাতির টাকা দিয়েই মা কালীর পুজো দিতেন।

বিশ্বাস পরিবারের পক্ষ থেকে আরো জানা যায় কালীপুজোর আগে ওঁরা ডাকাতি একটা হলেও করতেনই । যদিও বাঙলাদেশের দর্শনাতে একবার ডাকাতি করতে যাওয়ার পর ঘটেছিল একটা অদ্ভুত ঘটনা । ওইখানেই কর আদায়ের দায়িত্বে ছিলেন যে রানী ,তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ডাকাতদল হানা দিয়েছে। এইখান থেকে ডাকাতরা ডাকাতি করতে গিয়ে অদ্ভুত ঘটনারস্বাক্ষী হন । দেখেন ,ঢোকার মুখে যেন স্বয়ং মা দাঁড়িয়ে যিনি বলেন ,তোরা কথা দে ,আর তোরা ডাকাতি করবি না । আসলে ওঁদের শিক্ষা দিতে ওই রানী নিজেই নগ্ন হয়ে মা কালীর রুপ নিয়েছিলেন  হ্যাঁ ,সেদিনের পর থেকে ওঁরা ডাকাতি বন্ধ করে দেন । ‘পরবর্তীকালে গ্রামের ঘোষপাড়ায় চাঁদা তুলে মায়ের মন্দির গড়ে তোলেন ।আজও ডাকাতদের সেই কালী -ই ডাকাতে কালী নামে পুজো হয়ে আসছে আর যেখানে নিম গাছ তলায় প্রথম কালি পূজা করেছিলেন ডাকাতরা সেই থানে গ্রামের মহিলারা আজোও সকাল সন্ধ্যায় পূজা দেন ভক্তি ভরে ।এই কালী এইখানকার মানুষের কাছে অত্যন্ত জাগ্রত lবহু মানুষ এইখানে মায়ের পুজো দেন । পুজোর দিন হয় পাঁঠা বলি ।
প্রথা মেনে ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিন কাঁধে করে পুরো মাজদিয়া বাজার ঘুরে ডাকাতে কালিকে বিসর্জন করা হত । সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এখন টানা গাড়িতে করে বিসর্জিত হয় ডাকাতে কালি মাথা ভাঙা নদীতে।

Leave a Reply