মলয় দে, নদীয়া:- নদীয়ার শান্তিপুরের ঐতিহ্য পূর্ণ কয়েক শতাব্দী প্রাচীন বনেদি বাড়ির বড়ো মৈত্র বাড়ির দুর্গা প্রতিমার আরধনা বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য । এককথায় বলা যায় চৈতন্য পদধূলি ধন্য শান্তিপুরে বৈষ্ণব ও সাক্তের মিলন ক্ষেত্র হিসাবে বড়ো মৈত্র বাড়ির দশভূজা র আরাধনা এক চরম নিদর্শন ।
চৈতন্য পার্ষদ অদ্যতাচার্য্য , নাটোরের রাজগুরু এবং নদিয়ার কৃষ্ণ নগরের রাজবাড়ী — বাংলার সংস্কৃতির এই তিন পীঠস্থান কে স্পর্শ করে রয়েছে শান্তিপুরের বড়ো মৈত্র বাড়ির প্রায় ২৩০ – ৩৫ বছরের দুর্গা পুজো । পারিবারিক সূত্রে জানা গেলো একসময় বন্দুকের নল থেকে গুলি নিক্ষেপ করার পর এই বাড়ির মহাষ্টমীর সন্ধিপুজো র সূচনা হতো , এই বাড়িটির এই ঘরটিতেই একসময় বাইরে থেকে বাইজিরা আসতেন , রাত ভোর গান বাজনার আসর চলতো এবং তত্কালীন সময়ে তাদের মাথা পিছু দেওয়া হতো নগত এক হাজার টাকা এবং একটি হিরের আংটি , বর্তমানে এই ঘরটির ভগ্ন দশা বিদ্যমান । একসময়ে পালকি করে কলা বউ কে স্নান করতে নিয়ে যাবার রীতি বিদ্যমান ছিল । সব চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো এই বাড়ির দুর্গা পুজো অনুষ্ঠিত হয় দশ দিন ধরে , পূজো শুরু হয় মহালয়ার পরে প্রতিপদ তিথি থেকে । আরো একটি উল্লেখ যোগ্য বিষয় হলো এই বড়ো মৈত্র বাড়ির দুর্গা মূর্তি নদিয়ার কৃষ্ণ নগরের রাজবাড়ীর দুর্গা মূর্তির অনুকরণে তৈরি । কিন্তু সেটা কি কারণে তার কোনো কারণ জানা যায় নি । এই বাড়ীর দুর্গা পুজো হয় কালিকা পুরান মতে এবং এখানে দেবী বৈষ্ণবী , সেই কারণে বলি প্রথা বলবৎ নেই , মহাষ্টমীর দিন আখ , কুমড়ো , নারকেল এবং কলা মায়ের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার রীতি বিদ্যমান ।
ঐতিহাসিক তথ্য সূত্রে জানা গেল অদৈতাচার্যের বংশধর রাধা মোহন গোস্বামী ভট্টাচার্য্য ছিলেন নাটোরের রাজগুরু , তার কন্যা রাম মনির বিবাহ হয়ে ছিল ফরিদ পুরের রাম রতন মৈত্রের সাথে , বিবাহের পর বাবার কাছে আবদার করে গোপাল বিগ্রহ বাড়িতে আনেন রাম মনি এবং স্থির করেন বাড়ীতে গোপালের মন্দির স্থাপন করবেন । এরপর থেকেই এই বাড়িতে শুরু হলো গোপালের নিত্য সেবা এবং জন্মাষ্টমী , দোল ও নন্দতসবের মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠান , পরবর্তী কালে রাম মনি স্বপ্নে দশভুজা র দর্শন পান এবং তারপরেই মনস্থির করেন তিনি দুর্গা পূজা করবেন ।
এই বড়ো মৈত্র বাড়ির প্রবেশ পথের সুবিশাল দরজার মাথার ওপরে ১৩৫১ বা মতান্তরে ১৩৫৭ লেখা বাংলার সাল নির্দেশ করা আছে । বাড়ির মানুষের মতে এই সময় থেকেই পুজোর সূচনা হয়ে ছিল । বাড়ির মূল ফটকের মাথায় সুউচ্চ প্রাচীন নহবত খানা আজও প্রাচীন ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয় । যদিও একসময় দ্বিতল বিশিষ্ট মন্দির ছিল , দুপাশের বারান্দা সমস্তটাই কালের নিয়মে ইতিহাস হয়ে গেছে ।
বড়ো মৈত্র বাড়ির ঠাকুর মন্দিরেই মাতৃ মূর্তি নির্মাণ করার রীতি বলবৎ রয়েছে । এই বাড়ির দশভূজা তিন পুতুলের , এখানে দেবীর সন্তানরা অনুপস্থিত । প্রতিমার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এখানে দেবীর সিংহ অশ্ব মুখী সাধারণ ভাবে একে নল সিংহ বলা হয়ে থাকে । মাতৃ মূর্তি স্বর্ণ ও রৌপ্য দিয়ে সাজানো হয়ে থাকে , যদিও মাতৃ অঙ্গে ডাকের সাজ বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয় । পূর্বেই বলা হয়েছে নদিয়ার কৃষ্ণ নগরের রাজবাড়ীর দুর্গা প্রতিমা অনুকরণে এই বাড়ির মাতৃ মূর্তি । পারিবারিক সুত্রে জানা গেলো মহালয়ার পরে প্রতিপদ তিথি থেকে মাতৃ মূর্তির আরাধনা করা হয় বিল্ল বৃক্ষে ও বিশেষ ঘট স্থাপনের মাধ্যমে , সেই দিনেই সংকল্প করা হয় পরিবারের সকল সন্তানদের নামে ; মহাপঞ্চমি পর্যন্ত ওই ঘটেই দেবীর আরাধনা চলে । ষষ্ঠীর দিনে দেবীর বোধনের আরো একটি ঘট বসিয়ে বিল্ল বৃক্ষে দেবীর বোধন হয় এবং সপ্তমীর দিন আরো একটি ঘট স্থাপন করা হয় দেবীর সন্মুখে । মহা দশমীর দিন এই তিন ঘটের জল সম্মিলিত করে শান্তির জল দেওয়ার রীতি রয়েছে এই বাড়ীতে ।
এই বাড়িতে সপ্তমী , অষ্টমী ও নবমী এই তিন দিন মাতৃ মূর্তির উদ্দেশ্যে ভোগ নিবেদন করা হয় । যদিও মহাষ্টমীর দিন অন্ন ভোগ , পোলাও , খিচুড়ি , পরমান্ন , নানা রকম ভাজা , তরিতরকারি , চাটনি , মিষ্টি প্রভৃতি উৎসর্গ করা হয় । শুধুমাত্র মহাষ্টমীর দিনেই ভোগ বিতরনের প্রচলন রয়েছে । তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো মহা দশমীর দিন মাতৃ মূর্তির উদ্দেশ্যে কচুর শাক ও চালতার টক সহ পান্তা ভাতের ভোগ উৎসর্গ করার রীতি বলবৎ রয়েছে । প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য একসময় মহাষ্টমীর দিনে ১৫০০ থেকে ২০০০ মানুষকে ভোগ খাওয়ানো ও ভোগ বিতরনের রেওয়াজ ছিল এই বাড়ির থেকে । বর্তমানে বাড়ির অধিকাংশ মানুষেরই বাইরে থাকেন । পুজোর সময় তারা অনেকেই এই বনেদি পরিবারে একত্রে এই বাড়িতে এসে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন ।
পারিবারিক সূত্রে ও বিশেষ সূত্রে জানা যাচ্ছে এই বাড়ির দেবী অত্যন্ত জাগ্রত , এবং তিনি অত্যধিক আড়ম্বোর পছন্দ করেন না । অত্যাধিক আড়ম্বোরের সাক্ষী হতে গিয়ে কয়েক জন পারিবারিক সদস্যের মৃত্য ও হয়েছে বলে সূত্রের খবর ।
মাতৃ মূর্তি পুজো ও বিসর্জনের সময় বড়ো মৈত্র বাড়ীতে ডগোরের বাজনার রয়েছে । তবে সাম্প্রতিক করোনা পরিস্থিতির কারণে বিগত বছর থেকেই প্রতিমা নিরঞ্জনের শোভা যাত্রায় আরম্বর কমেছে বলেই জানা যাচ্ছে । এবছরে বাড়ির মূল ফটক অর্থাৎ প্রবেশ দ্বার থেকে শুরু করে মন্দিরের সমস্ত খাটাল বিশেষ পুষ্পের সাজে সজ্জিত করা হবে বলেই সূত্রের খবর ।