মলয় দে, নদীয়া:- পদ্মকে পবিত্র বলে মনে করেন বৌদ্ধরাও। পদ্মফুলকে অনেক দেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। গোলাপী পদ্ম গৌতম বুদ্ধের কিংবদন্তির ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়। মুসলমান ধর্মালম্বীদের মধ্যেও কোমল হৃদয়ের ভাবাবেগ বোঝাতে পদ্মের ব্যবহার দেখা যায়। দুর্গাপূজার সময় সন্ধিপুজোয় অবশ্যই প্রয়োজন ১০৮ টি পদ্মের।
হিন্দু ধর্মের কাহিনী অনুসারে নারায়ণের নাভি থেকে নির্গত পদ্ম ব্রহ্মার আসন, শ্বেত পদ্ম বিদ্যার দেবী সরস্বতী আসন। লক্ষ্মীপূজোতেও ধন দেবীর হাতে শোভা পায় পদ্ম। চৈত্র মাস থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত ফুল ফুটতে দেখা যায়। ইদানিং পূজো পার্বণ বাদ দিয়েও, বিশেষ একটি দলের রাজনৈতিক সভা সমিতি গুলিতেও পদ্মফুল সংবর্ধিত করা হয়। সিপাহী বিদ্রোহের সময় পদ্ম উপহার সাংকেতিক ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
পদ্ম, কমল, শতদল, সহস্রদল, উত্পল (পদ্ম বা শাপলা), মৃণাল, পঙ্কজ, অব্জ, অম্বুজ, নীরজ, সরোজ, সরসিজ, সররুহ, নলিনী, অরবিন্দ, রাজীব, ইন্দিরা, কুমুদ, তামরস নানা নামে পরিচিত থাকলেও ,
পুণ্ডরীক=শ্বেতপদ্ম
কোকোনদ=লাল পদ্ম
ইন্দিবর= নীল পদ্ম অত্যন্ত জনপ্রিয়।
শুধু মনোরঞ্জন বা উপহার হিসেবেই নয়, পদ্ম ফুলের পাপড়ি, পদ্মের বীজের ঔষধি গুণও যথেষ্ট। সুগন্ধি অ্যারোমা হিসেবে প্রসাধনী শিল্পে আন্টি এবেসোজনিক, ও অ্যান্টি ডায়াবেটিক ঔষধি গুন আছে। এছাড়াও ন্যুসিফেরিন, অ্যপোরফিন, জাতীয় অ্যালকালয়েড থাকার কারণে শ্বেতী রোগ হৃদশূল নিরাময়, মলদ্বারের হালিশ রোগ, প্রসবের পর নাড়ি সরে গেলে এই ধরনের নানান রোগের অব্যর্থ ঔষধ। পদ্মবীজ বেটে খেলে অকাল গর্ভপাত বন্ধ হয়, বিকৃত করা এবং পিত্ত সংশোধিত হয়।
রূপে গন্ধে অতুলনীয় এই ফুলটিকে বিনা কারণে আমাদের জাতীয় ফুল আখ্যা দেওয়া হয়নি। নেলম্বোনাসিয়া পরিবারের জলজ উদ্ভিদ, অত্যাশ্চর্য এই ফুল বিভিন্ন উপায়ে গ্রহণ করা যায়। কেবল ফুলই নয়, এর শিকড়, কান্ড এবং বীজ বিভিন্ন উপাদেয় খাবারে নিযুক্ত করা হয়।
পদ্মের শিকড় প্রচুর পরিমাণে ডায়েটরি ফাইবার, পটাসিয়াম, আয়রন এবং ভিটামিন বি এবং সি সমৃদ্ধ, এতে উপস্থিত পুষ্টি এবং খনিজগুলি বিবেচনা করে একে “স্বাস্থ্যকর খাবার” রূপে বিবেচনা করা হয়।
চলুন দেখে নিন পদ্মের কিছু অসাধারণ গুণাবলী –
পদ্মের শিকড়গুলির মধ্যে রয়েছে প্রয়োজনীয় ভিটামিন এ, যা ত্বক, চুল এবং চোখের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়ক বলে প্রমানিত। ভিটামিন এ এর অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট ক্ষমতা রয়েছে, যা ম্যাকুলার অবক্ষয় এবং চোখের অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ করতে পারে। এটি ক্ষত নিরাময়ে এবং ত্বকের প্রদাহজনিত চিকিত্সা করতে সহায়তা করে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, কাশি প্রশমিত করতে মধুর সাথে পদ্মের বীজ গুঁড়ো মিশ্রণ করে সেবন করলে তা নিরাময় হয়।
পদ্ম পাতা এবং মূলের নির্যাস দীর্ঘকাল ধরে মেনস্ট্রুয়াল পেন নিয়ন্ত্রণে এবং অতিরিক্ত রক্তপাত বন্ধ করতে ঔষধি রূপে ব্যবহৃত হয়। এটি রক্তাল্পতা কমাতেও সহায়তা করে।
পদ্মের শিকড়ে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স রয়েছে। এর একটি যৌগ, যা পাইরিডক্সিন নামে পরিচিত সেটি মস্তিষ্কের নিউরাল রিসেপ্টরগুলির সাথে সংযোগ স্থাপন করে, যা স্ট্রেস, খিটখিটে স্বভাব এবং মাথাব্যথা হ্রাস করতে ১০০ শতাংশ সহায়ক।
গবেষণা অনুযায়ী, পদ্মবীজে রয়েছে এমন এক যৌগ, যা ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি রোধ করে এবং লাঙ্গস ক্যানসার নিরাময়ে সহায়তা করে।
পদ্মে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ডায়েটরি ফাইবার, যা হজম ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। গ্যাস্ট্রিক আলসার, কোষ্ঠকাঠিন্যের মত রোগ এবং অন্ত্রের পেশীগুলিতে পেরিস্টালটিক (অন্ত্রের সংকোচন) গতি বাড়ায়।
এতে থাকা ডায়েটরি ফাইবার আপনাকে দীর্ঘ সময়ের জন্য পরিপূর্ণ রাখে। ওজন হ্রাস করতে এটি ব্যবহার করা হয়।
গ্রাম বাংলার বিভিন্ন নিচু চাষের জমির পুকুর ডোবাতে যথেষ্ট পরিমাণে এই ফুল প্রাকৃতিকভাবেই জন্মে থাকে, তবে উপযুক্ত সরকারি তত্ত্বাবধান এবং যথেষ্ট হিমঘরের ব্যবস্থা না থাকায় অনেকেই আগ্রহী নন, পদ্মপাতা বা ফুল বিক্রিতে। তবে ইদানিং কিছু জায়গায় এর চাষ ও লক্ষ্য করা যায়, অত্যাধিক কম খরচে এই চাষে শুধুমাত্র গোবর সারের প্রয়োজন, অতি দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করে পুরো পুকুর বিস্তৃত হয়ে যায় মাত্র অল্প ক’দিনে। এমনকি সামান্য দু একটি শিকড় থেকেই পরেরবার আবারো পদ্ম সাম্রাজ্য গড়ে তোলে।
দুবিঘের এর একটি পুকুরের প্রতিমাসে গড়ে ৫০০০ ফুল পাওয়া যায়। যার বাজার দাম ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এরপর পাতা তো থাকলোই! কিন্তু সরকারি তত্ত্বাবধান , সঞ্জয়ের হিমঘর এবং উপযুক্ত বাজারের সন্ধান পেলেই গ্রাম বাংলার পর্যাপ্ত পরিমাণে ফুল পুকুরেই ঝরে পড়তো না!